গত ১০ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয় ৪১তম শেষ স্প্যানটি। সেতুর মোট পিলার ৪২টি এবং এতে স্প্যান রয়েছে ৪১টি। একেকটি স্প্যান জোড়া দিয়েছে কোটি বাঙালির স্বপ্নকে। চোখের সামনে পূর্ণতা পেল ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার স্বপ্নের এই সেতু। এর মধ্য দিয়ে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ার সঙ্গে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়েছে।
পদ্মা সেতুর ৪১টি স্প্যান তৈরি হয়েছে চীনের হুবেই প্রদেশের শিংহুয়াংডাও শহরে। বাংলাদেশে এনে করা হয়েছে জোড়া লাগানো ও রং করার কাজটি। চীন থেকে আনার সময় স্প্যানের বিভিন্ন অংশের রং ছিল অনেকটা সোনালি। চীন থেকে বিযুক্ত অবস্থায় আনার পর দেশে জোড়া দিলে একেকটি স্প্যানের ওজন দাঁড়ায় ৩ হাজার ২০০ টন। সেগুলো জার্মানির ক্রেন দিয়ে পদ্মা সেতুর পিলারের ওপর বসানো হয়।
এই সেতুর মূল কাঠামোর রং ধূসর। কেন এই রংটি বেছে নেয়া হলো, তার পেছনে যুক্তি আছে। উদ্বোধনের দিন এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে পদ্মা সেতুতে আলোকসজ্জার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে আধুনিক শহর গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন। সেতুর রং বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এসব বিষয় কাজ করেছে।
জোড়া লেগেছে কোটি মানুষের স্বপ্ন
পদ্মা সেতু প্রকল্প সূত্র বলছে, সাধারণ সব সেতুতেই সড়কবাতি বা স্ট্রিট লাইট দেয়া হয়। পদ্মা সেতুতেও সেটা থাকবে। তবে বাড়তি হিসেবে এই সেতুর বিভিন্ন স্থানে নানা রঙের আলোকসজ্জার ব্যবস্থা থাকবে। সেতু কর্তৃপক্ষ চাইলে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের মতো জাতীয় উৎসবে আলোকসজ্জার সুযোগ থাকবে। এটাকে বলা হচ্ছে আর্কিটেকচারাল লাইটিং। দুবাইয়ের সুউচ্চ ভবন বুর্জ আল খলিফা টাওয়ারে আলোর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের জাতীয় পতাকা ফুটিয়ে তোলা হয়। পদ্মা সেতুতেও একইভাবে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেতু বিভাগের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ধূসর রঙের মধ্যে আলো ফেললে বেশি ফুটে উঠবে। এ জন্যেই এই রং বাছাই করা হয়েছে। রং সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি। তিনি বলেন, এই রং ২৫ বছর স্থায়ী হবে বলে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।
পদ্মা সেতু দেখতে অনেকটা ইংরেজি বর্ণ ‘এস’-এর মতো। এর পেছনে কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষ বলছে, সেতু সোজা হলে রাতে যানবাহনের চালকের ঝিমুনি আসতে পারে। তারা যেন চলার সময় সতর্ক থাকেন, এ জন্য কিছুটা বাঁক দেয়া হয়েছে। সাধারণত বেশি দৈর্ঘ্যের সেতু একটু বাঁকানো আকৃতিতে তৈরি করা হয়। আরেকটি বিষয় হলো সৌন্দর্যবর্ধন। ‘এস’ আকৃতির হলে সেতু দেখতে সুন্দর দেখায়।
বিজয়ের মাসেই পুরো সেতু দৃশ্যমান হওয়ায় পদ্মা জয়ের স্বপ্নপূরণ হয়েছে। শুধু তাই নয় দেশের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে তিনটি বিশ্ব রেকর্ডও হয়েছে। বিশ্ব রেকর্ড তিনটি হলো- বিশ্বের দীর্ঘতম ১২২ মিটার পাইল স্থাপন, ১৫ টন ওজনের ৯৮৭২৫ কিলো নিউটন ক্ষমতা সম্পন্ন ফিকশন প্যান্ডিলাম বেয়ারিং ব্যবহার ও নদী শাসনের সর্বোচ্চ ১.১ বিলিয়ন (প্রায় ৮ হাজার ৮শ’ কোটি) টাকার চুক্তি।
এই সেতুতে দৈনিক চলবে ২৪ হাজার যান
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৯টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সড়কপথের যোগাযোগ স্থাপনের জন্য পদ্মা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। তারই অংশ হিসেবে ১৯৯৯ সালে ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ’ প্রকল্পের প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল। পরে ২০০৩ থেকে ২০০৫ সালে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) মাধ্যমে এর সম্ভাব্যতা যাচাই হয়। সেই সম্ভাব্যতার ওপর ভিত্তি করে ২০০৭ সালে পদ্মা বহুমুখী সেতুর মূল উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়ন হয়। তখন ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা খরচে ২০০৭-২৮ থেকে ২০১৪-২০১৫ মেয়াদে পদ্মাসেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব অনুমোদন হয়।প্রথম সংশোধিত ডিপিপি পর্যন্ত মোট প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৬ হাজার ২৪৯ কোটি ৫২ লাখ (৭৯ দশমিক ২৪ শতাংশ) টাকা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) দেয়ার কথা ছিল। সেই লক্ষ্যে ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক, একই বছরের ১৮ মে জাইকা, ২৪ মে আইডিবি এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
এই সেতুর মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপিত হবে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার
বিশ্বব্যাংক অর্থ প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করলে ২০১২ সালের ৯ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জনগণের অর্থে পদ্মাসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তের কথা জানান। তখন সেই সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষের ব্যাপক সমর্থনও পান।তবে বিশ্বব্যাংকের দেয়া দুর্নীতির অভিযোগের কলঙ্ক বেশিদিন বইতে হয়নি বাংলাদেশকে। ২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কানাডার টরেন্টোর একটি আদালতে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। কানাডার আদালতের রায়ে বলা হয়, এই মামলায় যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে, তা অনুমানভিত্তিক, গালগল্প এবং গুজবের বেশি কিছু নয়।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হলে এর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হবে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার। ফলে পদ্মা সেতু দিয়ে দৈনিক চলবে ২৪ হাজার যান। ২০০৯ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) একটি জরিপে দেখা যায়, ২০২২ সালে পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে, ওই বছর সেতু দিয়ে চলাচল করবে প্রায় ২৪ হাজার যানবাহন। সংখ্যাটি প্রতিবছরই বাড়বে। ২০৫০ সালে প্রায় ৬৭ হাজার যানবাহন চলবে পদ্মা সেতু দিয়ে।
ভূমিকম্পসহ একসঙ্গে ভয়াবহ বহুমাত্রিক ধাক্কা-দুর্যোগ সামলে নেয়ার সক্ষমতা নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে পদ্মাসেতু। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এ তথ্য জানান। পদ্মাসেতু নির্মাণাকারী কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সেতু বিভাগের সাবেক এই সচিব জানান, সমসমায়িক বিশ্বে কোনো নদীতে নিমির্ত সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মাসেতু। নির্মাণাধীন এ সেতুকে বলা হয় বাংলাদেশের ‘স্বপ্নের সেতু’। কংক্রিট কাঠামোর খুঁটি ও ইস্পাতের স্প্যানের এই সেতু এতই শক্তিশালী যে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল।
তিনি আরো বলেন, যদি কখনো রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। আর ঠিক তখনই যদি পিলারের নিচে থেকে ৬৫ মিটার মাটি সরে যায়। একই সময় যদি পুরো সেতু রেল এবং যানবাহনে লোড থাকে। ওই সময় ৫ হাজার মেট্রিক টন ওজনের আরো একটি জাহাজ এসে সেতুর পিলারে ধাক্কা মারে তাহলেও পদ্মাসেতুর কিছুই হবে না।