শেরপুরের নালিতাবাড়ীর ভোগাই নদীতে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নাকুগাঁও স্থলবন্দর এলাকার ভোগাই ব্রীজ হুমকীর মুখে পড়েছে। যে সেতর ওপর দিয়ে সিলেটের তামাবিল পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করেছে বর্তমান সরকার। সেইসাথে হুমকিতে রয়েছে সীমান্তের বুরুঙ্গা এলাকার অপর একটি সেতু। পৌর শহর এলাকায় ভোগাই নদীতে গত দেড় বছর ধরে চলছে বালু দস্যুদের লুটপাট। এতে নদীগর্ভে বিলীন হতে চলেছে নালিতাবাড়ী শহর রক্ষা বাঁধ। এছাড়াও শহরের গুরুত্বপুর্ণ বেশ কয়েকটি স্থাপনা হুমকীর মুখে রয়েছে।
নালিতাবাড়ী শহরের বুক চিরে বয়ে চলেছে পাহাড়ী খরস্রোতা নদী ভোগাই। আশির দশকে ভোগাইকে নালিতাবাড়ীর দুঃখ বলা হতো। প্রতি বছর বর্ষা এলে চরম দুর্ভোগ পোহাত মানুষ। বর্তমান পৌর শহরটি ডুবে যেতো পানিতে। ব্যবসা-বানিজ্য বন্ধ হয়ে যেত। নদীর পানিতে ডুবে সে সময় অসংখ্য মানুষের প্রাণ গেছে। ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মত নালিতাবাড়ী-নকলা আসনে (শেরপুর- ০২) এমপি হন সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। এসময় তিনি স্থানীয় মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা শুনে শহর রক্ষা বাঁধ করার জন্য তৎকালীন সরকারের কাছে দাবী জানান। তৎকালীন সরকার শহর রক্ষা বাঁধ করতে অনিহা দেখায়। এর প্রতিবাদে ১৯৯২ সালের নভেম্বর মাসে তিন দিনের অনশনের ডাক দেন বেগম মতিয়া চৌধুরী। এসময় তিনি একটানা ২৪ ঘন্টা অনশন করেন। বেগম মতিয়া চৌধুরীর আমরণ অনশনে সরকার বাধ্য হন বাঁধ তৈরি করে দিতে। ১৯৯৩ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ নির্মাণ কাজের দরপত্র আহবান করেন। ১৯৯৪ সালে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যায়ে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কৃষিমন্ত্রী হন মতিয়া চৌধুরী। তিনি বাঁধের জন্য আরও দুই কোটি টাকা বরাদ্দ এনে দেন। ১৯৯৯ সালে কংক্রিট ব্লক দিয়ে শহরের তারাগঞ্জ ছিটপাড়া শহীদ আব্দুর রশিদ মহিলা কলেজ থেকে কাচারীপাড়া গঙ্গা মন্দির পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার শহর রক্ষা বাঁধ নির্মিত হয়। শত বছরের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পান শহরবাসী। পরবর্তীতে প্রমত্তা ভোগাইয়ের ভাঙ্গনরোধে প্রায় প্রতিবছর নিজের টিআর-কাবিটা থেকে তিনি পরিকল্পিতভাবে ভোগাই নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট খনন করে আসছিলেন। এর ফলে পাহাড়ী ঢল ও বন্যা হলেও নালিতাবাড়ীতে ক্ষয়-ক্ষতি অনেক কম হয়।
গত ১৪২৬ বঙ্গাব্দে স্থানীয় এক শ্রেণির প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ী ভোগাই নদীর বিভিন্ন অংশে অপরিকল্পিতভাবে শ্যালু মেশিন বসিয়ে পাইপের মাধ্যমে যত্রতত্র বালু উত্তোলন শুরু করে। প্রশাসনের নাকের ডগায় নির্দয়ভাবে নদী থেকে বালু তোলার ফলে শহর রক্ষা বাঁধের বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দেয়। বর্তমানে দেড় কিলোমিটার বাঁধের বিভিন্ন অংশে প্রায় ২৫০ মিটার নদী গর্ভে চলে গেছে।
নালিতাবাড়ী শহরের কাচারী পাড়া মহলার বাসিন্দা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান রিপনের সদ্য নির্মিত বাসভবনের পিছনের অংশে বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছে। এতে নতুন ভবনটি হুমকির মুখে পড়েছে। বাঁশের খুটি ও বালির বস্তা ফেলে তারা বাড়ী রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। এছাড়া আমবাগান এলাকায় সাবেক নৌ-পরিবহন সচিব আব্দুস সামাদ ফারুকের বাস ভবনের পাশে ব্লক ভেঙ্গে গেছে। সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৪ লাখ টাকা ব্যায় করে ৫০ মিটার এলাকাজুড়ে ৫ হাজার বালির বস্তা ফেলে সাবেক সচিবের বাসভবন রক্ষায় বেরিক্যাড দিয়েছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ অপরিকল্পিতভাবে বাঁধের ব্লকের সামনে হাজার হাজার বালির বস্তা ফেলায় নদীর পানির প্রবাহ গতি পরিবর্তন করেছে এবং পানি পাক খেয়ে পূর্বদিকে গিয়ে আঘাত করছে। এতে আমানুলাহ রাইস মিল ও দেওয়ান রাইস মিল এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হতে চলেছে। স্থানীয় তারাগঞ্জ আলিম মাদরাসাটিও নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। আমবাগান এলাকার আইনজীবি গোলাম কিবিরয়া বুলু, সাংবাদিক এমএ হাকাম হীরা ও আনোয়ার মঞ্জিলের বাস ভবন ও থানা মসজিদসহ বেশ কয়েকটি বসতবাড়ীও হুমকির মুখে রয়েছে।
শেরপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি অ্যাড. গোলাম কিবিরয়া বুলু বলেন, বালুখোকোর দল যত্রতত্র বালু তোলায় নদী গভীর হয়ে গেছে। ফলে পাহাড়ী ঢল এলে শহর রক্ষা ব্লকের নিচে পানি আঘাত হানছে। এতে আস্তে আস্তে বাঁধটি ভেঙ্গে পড়ছে।
শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু সাইদ বলেন, আসলে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে বাঁধের বেশ কয়েকটি অংশে ভেঙ্গে পড়ছে। শহর রক্ষা বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, ভাঙ্গন প্রতিরোধে আমরা যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়েছি তা পরিকল্পিত। শহরের আশে-পাশে যাতে কেউ বালু তুলতে না পারে উপজেলা প্রশাসনকে তাঁর ব্যবস্থা নিলে শহর রক্ষা বাঁধটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
এ ব্যাপারে নালিতাবাড়ীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহফুজুল আলম মাসুম বলেন, আমি নালিতাবাড়ীতে যোগদান করার পর ঘোষনা দিয়েছি সেতু বা ব্রীজের এক কিলোমিটারের মধ্যে কেউ বালু তুলতে পারবে না। ইতোমধ্যে এক ব্যবসায়ীকে অবৈধ বালু তোলার দায়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন উপজেলার ১০ জন ইউপি চেয়ারমান বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে সড়ক ও সেতু মন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন। আবেদনটি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।