শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে ভুয়া দলিল তৈরি করে ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর গারো আদিবাসী সম্প্রদায়ের এক বিধবার ৪৬ শতাংশ জমি দখল চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে আব্দুুল মান্নান নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার সীমান্তবর্তী নয়াবিল ইউনিয়নের ডালুকোনা দাওধারা গ্রামে। এতে বিপাকে পড়েছেন জমির প্রকৃত দখলদার মালিক জসপিনা নেংমিনজা। এই ঘটনার উপযুক্ত বিচার দাবি করেছেন তিনি।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ষাটের দশকে ভারতে চলে যাওয়া প্রবাসু কোচ নামের এক ব্যক্তির স্থলে ২০১১ সালে ভুয়া মালিক বানিয়ে ভিন্ন দলিল তৈরি করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বিধবা জসপিনার জমি জবরদখলের চেষ্টা করছেন পাশ্ববর্তী দাওধারা গ্রামের আব্দুল মান্নান ওরফে কেওরা দেওয়ানী।
উপজেলার নয়াবিল ইউনিয়নের ডালুকোনা মৌজার বর্তমান ২৪ নং খতিয়ানে ও ১১৪ নং দাগে ৪৬ শতক জমির প্রকৃত রেকর্ডীয় মালিক ছিলেন প্রবাসু কোচ। ষাটের দশকে প্রথমে গ্রাম্যভাবে ও পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালের ৪ জুলাই প্রবাসু কোচ ওই জমি স্থানীয় তাজিমনি সাংমাকে রেজিস্ট্রি দলিলে বিক্রি করে দিয়ে ভারতে চলে যান।
তাজিমনির উত্তাধিকারসূত্রে ওই জমি প্রাপ্ত হন তারই কন্যা জসিন্তা সাংমা ওরফে আশুমণি সাংমা। ১৯৯৯ সালের ১২ এপ্রিল জসিন্তা সাংমা ওই জমি তার আপন ভাগ্নি জসপিনা নেংমিনজাকে সাব-রেজিস্ট্রি করে লিখে দেন। তবে নিজেদের ভোগদখলে থাকায় সহজ সরল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী গারো সম্প্রদায়ের তাজিমনি, জসিন্তা ও জসপিনা তাদের দখলীকৃত জমির নিজেদের নামে রেকর্ড বা নামখারিজ নিয়ে কখনো ভাবেননি। ফলে গোপনে সুযোগ নেন প্রতিবেশি আব্দুল মান্নান।
এদিকে, জমি বিক্রির পর ১৯৬৪ সালে ভারতে চলে যাওয়া প্রবাসু কোচের স্থলে চতুর আব্দুল মান্নান ভুয়া প্রবাসু কোচ বানিয়ে ২০১১ সালের ৬ জানুয়ারি একই জমি স্থানীয় দাওধারা গ্রামের চরিত্র সরকারের নামে লিখে নেন। পরে চরিত্র সরকার ওরফে চরিত্র হাজং এর কাছ থেকে ওই জমি ২০২১ সালের ২৬ আগস্ট নিজ নামে লিখে নেন আব্দুল মান্নান। বিষয়টি গোপন রেখেই ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তার সাথে যোগসাজশ করে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর ওই জমির নামখারিজও সম্পন্ন করান আব্দুল মান্নান। এক পর্যায়ে বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়লে চলতি বছর উপজেলা ভূমি কর্মকর্তার কার্যালয়ে ওই খারিজ বাতিল করতে আবেদন করেন জসপিনা নেংমিনজা।
নালিতাবাড়ী ট্রাইবাল ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও আদিবাসী নেতা মি. লুইস নেংমিনজা বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের জমি রেজিস্ট্রি করতে হলে স্থানীয় ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র লাগে। এই প্রত্যয়নপত্র প্রদানসাপেক্ষে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) দেওয়া একটি নম্বর দলিলে উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু আব্দুল মান্নানের কথিত দলিলে এমন কোন নম্বর বা ট্রাইবাল চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র নেই।
প্রতিবেশী মি. প্রদীপ ম্রং বলেন, আমি ৩৫ বছর যাবত দেখে আসছি ওই জমি জসপিনা ভোগদখল করে আসছেন। কিন্তু হঠাৎ করে কয়েক দিন আগে জমির একপাশে রাতের অন্ধকারে ঘর তুলেছেন আব্দুল মান্নান। সে প্রকৃত মালিক না।
ভুক্তভোগী জসপিনা সাংমার ছেলে রাসেল নেংমিনজা বলেন, আমরা কয়েকদিন আগেও ওই জমিতে আকাশমনি গাছের চারা রোপন করেছি। হঠাৎ একদিন সকালে ওঠে দেখি জমির একপাশে আব্দুল মান্নান ঘর তুলে রেখেছেন। এসময় তিনি জমি জবরদখল নিয়ে আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে বলেন এটির সঠিক সুরাহা হওয়া উচিত।
জবরদখলকারী অভিযুক্ত আব্দুল মান্নান বলেন, এই জমি আমার। আমি চরিত্র সরকারের কাছ থেকে জমি কিনে নিয়েছি। চরিত্র সরকার তিনি কার কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন সেটা আমার দেখার বিষয় না। তবে জমির মূল্য, দলিলে উল্লেখিত সাক্ষ্য ও জবর দখল নিয়ে তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি।
এ ব্যাপারে চরিত্র সরকার বলেন, জমির রেকর্ডীয় প্রথম মালিক প্রবাসু কোচকে আমি চিনি না। আব্দুল মান্নান নিজে উদ্যোগ নিয়ে প্রবাসু কোচ বানিয়ে সাব রেজিস্ট্রার অফিসে নিয়ে আমাকে জমি দলিল করে দিয়েছে। পরে আমি ওই জমি আব্দুল মান্নানকে আমি লিখে দিয়েছি।
এমতাবস্থায় এই জমির প্রতিকার চেয়ে উপজেলা ভুমি অফিসে নামজারী বাতিলের আবেদন ও থানায় অভিযোগ দাখিল করেছেন বিধবা জসপিনা নেংমিনজা। অপরদিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী গারো সম্প্রদায়ের নামীয় এবং ভোগদখলীয় এ সম্পত্তির বিরোধ নিষ্পত্তিতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের সৃ-দৃষ্টি প্রত্যাশা করেছেন এলাকাবাসী।