‘কত আশাই না করছিলাম। আমার দুই পুলার বউ একলগে ঘরে তুলমু। সামনের মাসেই তো একলগে দুই পুলার বিয়ার অনুষ্ঠান করতাম। ছুডু পুলা তো আর রইলো না গো। সব শেষ কইরা দিলা আল্লাহ। আমার কইলজার টুকরারে তুমি আগুন্স পুড়াইয়া মারলা আল্লাহ। অহন আমি কী নিয়া বাঁচমু?’ নারায়ণগঞ্জে গ্যাস পাইপ লাইনের বিস্ফোরণে দগ্ধ শ্রমিক সাইফুলের (২৪) মৃত্যুর খবর পেয়ে ১৭ অক্টোবর মঙ্গলবার বিকেলে এভাবেই বিলাপ করছিলেন তাঁর মা সোফিয়া বেগম।
নিহত সাইফুল শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বরুয়াজানি গ্রামের নূর ইসলামের ছেলে। গত শনিবার ভোরে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের শারমিন স্টিল লিমিটেড নামের কারখানায় গ্যাস পাইপ লাইনের বিস্ফোরণে পাঁচ শ্রমিক দগ্ধ হন। এর মধ্যে চারজনের বাড়িই শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে।
নালিতাবাড়ীর চারজন দগ্ধ শ্রমিক হলেন, গতকাল বিকেলে মারা যাওয়া উপজেলার বিশগিরীপাড়া এলাকার মোজাম্মেল (৩০) ও আজ দুপুরে মারা যাওয়া সাইফুল। দগ্ধ বাকি দুজন হলেন উপজেলার বরুয়াজানি গ্রামের খাইরুল ইসলামের ছেলে ইকবাল হোসেন (২৭) ও আব্দুল হাইয়ের ছেলে জাকারিয়া (২২)। তাঁরা মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন।
সাইফুলের পরিবার ও এলাকার লোকজন জানান, প্রায় এক মাস আগে বিয়ের কাবিন করেন নিহত সাইফুলের বড় ভাই শাহীন। পরে পরিবারের পছন্দেই পাশের এলাকায় বিয়ে ঠিক করা হয় সাইফুলেরও। পরিবারের ইচ্ছে ছিল আগামী নভেম্বর মাসে একসঙ্গে দুই ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান করে স্ত্রীদের ঘিরে তোলা হবে। কিন্তু সাইফুলের আর বিয়ের পিঁড়িতে বসা হলো না।
জীবিকার তাগিদে ১২ দিন আগে নারায়ণগঞ্জের একটি স্টিল কারখানায় চাকরি নেন সাইফুল। গত শনিবার ভোরে গ্যাস বিস্ফোরণে সাইফুল দগ্ধ হন। পরে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৭ অক্টোবর দুপুরে সাইফুলের মৃত্যু হয়।
১৭ অক্টোবর বিকেলে সাইফুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির উঠানে বসে বিলাপ করছেন সোফিয়া বেগম। মোবাইল ফোনে ছেলের ছবি দেখে চুমু খাচ্ছেন আর চিৎকার করে কাঁদছেন। ছেলের দগ্ধ হওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকেই না খেয়ে থাকায় দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। বিলাপ করতে করতে মাঝেমধ্যে জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি। আবার জ্ঞান ফিরলেই ছেলের কথা বলে আবার কাঁদছেন। তাঁকে ঘিরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন এলাকাবাসী ও স্বজনেরা। সাইফুলের বাবা নূর ইসলাম নির্বাক হয়ে চেয়ারে বসে আছেন।
সাইফুলের মা সোফিয়া বেগম বলেন, ‘আমি এমনই হতভাগা মা যে বাঁইচা থাকতে পুলার মুখটাও শেষ বারের মতো দেখবার পাইলাম না। আল্লাহ আমার আয়ুটুকু আমার বাপধনরে দিতা। আমগর সব আশা, সব স্বপ্ন তো শেষ হইয়া গেল। অহন তো আমি লাশ হইয়া বাঁইচা রইলাম।’
সাইফুলের বাবা নূর হোসেন বলেন, ‘আমার বড় পুলা শাহীন আর ভাতিজা মিজান ঢাকায় আছে গো। অরাই লাশ লইয়া আইবো। আল্লাহ যদি আমার জীবনের বিনিময়ে হইলেও আমার পুলার জান ফিরাইয়া দিত।’
সংশ্লিষ্ট কাকরকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নিয়ামুল কাউসার বলেন, ‘আজ সকালেই নিহত মোজাম্মেলের দাফন হয়েছে। আর দুপুরেই শুনলাম সাইফুলের মৃত্যু সংবাদ। বাকিদের অবস্থাও নাকি ভালো না। আমি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে থাকার চেষ্টা করব।’