‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড-তাই সবার জন্য শিক্ষা চাই’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে শেরপুরের নকলা উপজেলাধীন চন্দ্রকোণা ইউনিয়নের হুজুরীকান্দা গ্রামে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের দিবাকালীন সেবা ও বিশেষ ব্যবস্থায় শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা হয়েছে অটিস্টিক ডে-কেয়ার সেন্টার।
জার্মান নাগরিক ১০ জন বন্ধুর অর্থায়নে মোটিভেশন এ্যাওয়্যার্নেস ট্রেনিং এন্ড ইমপ্লিমেন্টেশন (মাটি) কতৃক পরিচালিত অটিস্টিক ডে-কেয়ার সেন্টারটি প্রতিবন্ধী তথা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষালয় ও নিরাপদ ঠিকানায় পরিণত হয়েছে। ৮থেকে ১০বছর বয়সী ১২জন অটিস্টিক শিশু নিয়ে ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করে ‘নকলা অটিস্টিক ডে-কেয়ার সেন্টার’। তার পর থেকে কর্ম দিবসগুলিতে সকাল ৯ টা হতে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সেন্টারটিকে একঝাঁক অটিস্টিক শিশু কিচিরমিচিরে মাতিয়ে রাখে।
ওই ডে-কেয়ারের সেবা ভোগ করছেন বিভিন্ন চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও কৃষিজীবী পরিবারের মা-বাবা। বিভিন্ন পেশাজীবী মায়েরা তাদের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিরাপদে রাখতে ও বিশেষ কৌশলের মাধ্যমে বাচ্চাদের শিক্ষা গ্রহণে ওই অটিস্টিক ডে-কেয়ার সেন্টারের প্রতি আস্থা পেয়েছেন। এখানে ভর্তিকৃত শিশুদের শিক্ষা উপকরণ, খাবার, যাতায়তের জন্য পরিবহণ, পোষাক, ক্রীড়া সামগ্রী, বিনোদন ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু সেন্টার থেকে বিণামূল্যে সরবরাহ করা হয়।
সম্প্রতি ওই সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, কায়দা ও হুজুরীকান্দা গ্রামের ৪জন করে, জানকীপুরের ৩জন, চরমধুয়ার ২জন, বন্দটেকী ও চরকৈয়া গ্রামের ১জন করে অটিস্টিক শিশু কার্পেট বিছানো ঘরে খেলাধুলায় মগ্ন। কেউ দৌড়াদৌড়ি করছে, কেউবা আবার বিভিন্ন খেলনা নিয়ে ইন্ডোর গেমস্ নিয়ে মগ্ন। শিশুদের সাথে আছেন ওই সেন্টারের শিক্ষক রিপা রানী এবং আরও দুইজন কর্মকর্তা ।
ওই অটিস্টিক ডে-কেয়ার সেন্টারের প্রধান কর্মকর্তা শিক্ষক রিপা রানী শেরপুর টাইমসকে জানান, এখানের প্রতিবন্ধী তথা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিণামূল্যে দেওয়া হয়। সেন্টারে ভর্তিকৃত জানকীপুর গ্রামের শিক্ষার্থী জুঁইয়ের মা রোজিনা ও তামিমের বাবা আব্দুল্লাহ; কায়দার মিস্টারের বাবা সাইদুল ও নীরবের মা নুরজাহান; চরমধুয়ার জিমহার বাবা জিয়াউর রহমান, হুজুরীকান্দার আরিফার বাবা আমিনুল, বন্দটেকী গ্রামের জাকিয়ার মা আফরোজা এবং চরকৈয়ার এনামের বাবা হেদায়াতুল্লাহ জানান, এখানে বাচ্চাদের রেখে তাদের বাড়তি কোন চিন্তা করতে হয়না। তারা বলেন, এটি শুধু ডে-কেয়ার নয়, অটিস্টিক শিশুদের নিরাপদ শিক্ষালয়ে পরিণত হয়েছে।
মাটি’র প্রোগ্রাম অফিসার মোঃ জাহাঙ্গীর আলম লেলিন শেরপুর টাইমসকে জানান, এখানে শিশুদের দুইবেলা খাবার, একবার টিফিন, চিকিৎসা, খেলাধুলা, বিনোদন, ভ্রমন, ধর্মচর্চা, যাতায়াতসহ সবকিছু রুটিন অনুযায়ী সম্পূর্ণ বিণামূল্যে করা হয়। এসব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে রয়েছে আলাদা লোক। ঐসব শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন ভাতাটাও চলে জার্মান নাগরিক ওই ১০বন্ধুর অর্থায়নেই। তাছাড়া মাটি অফিসের তত্বাবধানে এবং জার্মানের অর্থায়নেই মেডিক্যাল ফ্রি-ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে এপর্যন্ত ৫শতাধিক দাঁতের রোগীকে, সহ¯্রাধিক চোখের রোগীকে ফ্রি চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। সেন্টারে পরিচালিত মাধ্যমিক শাখার বিদ্যালয়ের দুই শতাধিক শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া সেন্টারে রয়েছে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি, জৈব বালাইনাশক তৈরি, স্তুপ ও গর্ত কম্পোস্ট তৈরী প্রকল্প, বিভিন্ন ফলজ ও ঔষধি গাছের বাগানসহ কৃষি সহায়ক বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক প্রকল্প।
মাটি’র সকল কার্যক্রমের সুনাম উপজেলা-জেলা ছাড়িয়ে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এমন মন্তব্য করছেন স্থানীয় জনগন। এবিষয়ে উপজেরা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজীব কুমার সরকার বলেন, আমি শুনেছি নকলায় একটি অটিস্টিক ডে-কেয়ার সেন্টার আছে, আমি নতুন আসায় তা দেখার সুযোগ হয়নি। তবে খুব দ্রুতি সরেজমিনে পরিদর্শনে যাব। এদেশে অটিস্টিক শিশুর গড় হার ০.১৫ শতাংশ। এই বিশাল শিশুদের জন্য পড়ালেখার পাশাপাশি তাদের মানসিক বিকাশের সুযোগ সৃষ্টিতে প্রতি উপজেলায় অন্তত একটি করে এরকম অটিস্টিক ডে-কেয়ার সেন্টার হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। প্রতি উপজেলায় সরকারি ভাবে অটিস্টিক ডে-কেয়ার স্থাপন সম্ভব নাহলেও; বেসরকারি বা দাতা সংস্থার অর্থায়নে অথবা ব্যাক্তি মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত হলেও তা দেশের উন্নয়নে কাজে আসবে বলে মনে করছেন সুধিজনরা।