ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং খাসিয়া পাহাড়ের চুড়ায় উঠে অন্য পাহাড়ের দিকে তাকালে দেখা যাবে প্রায় ১৫০০ ফুট সুউচ্চু পাহাড়ের গায় যেন সাদা সাদা মেঘগুলো ঘুমিয়ে আছে। কোন রকম নাড়াচড়া নেই। শিশুরা যেমন মায়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকে ঠিক তেমনি। এ দৃশ্য আসলে সচক্ষে কেউ না দেখলে কাউকে বিশ্বাস কারানো বা বোঝানো খুব কঠিন। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের নামটিই হয়েছে মুলত পাহাড় আর মেঘের কারনে। কেউ কেউ বলে মেঘের বাড়ি অর্থাৎ ‘মেঘের আলয়’ থেকেই হয়েছে ‘মেঘালয়’ নাম। আসলেই সত্যি। মেঘালয়ের বিশেষ করে ওই রাজ্যের রাজধানী শিলং এর খাসিয়া পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া জলপ্রপাতের (ফলস্) পানি নদীতে ছুটে চলার পর আবারও তা মেঘ হয়ে ওই পাহাড়ের বুকেই ফিরে আসে। সে এক অদ্ভুদ দৃশ্য নিজের চোখে না দেখলে এর অনুভূতি বোঝানো সম্ভব নয়।
ভারতের সেভেন সিস্টার খ্যাত উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী হলো শিলং। পাহাড়, ঝরনা, বৃষ্টিস্নাত সবুজ প্রকৃতি ইত্যাদি মিলে প্রকৃতি যেন আরেক স্বর্গ রচনা করেছে এখানে। বছরে ছয় থেকে সাত মাস মেঘালয় মেঘে ঢাকা থাকে। মেঘেদের খেলাঘর এই রাজ্যটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে এখানে ছুটে আসে। আমরা যারা পাহাড় ও ঝরনা দেখতে খুব ভালোবাসি তাদের জন্য এই রাজ্যটি হতে পারে একটি পরিতৃপ্তির জায়গা।
সম্প্রতি আমরা তিন বন্ধু গিয়েছিলাম এ সীমান্ত দিয়ে। শেরপুর থেকে সিলেট হয়ে শিলং এর পথ অনেক। তাই বাড়ির পাশেই সীমান্ত বলে সকাল ৮ টায় বেড়িয়ে পরি। সকাল ৯ টায় থেকে ১১ টার মধ্যে নাকুগাঁও-ঢালু সীমান্ত পার হয়ে তুরা শহরে পৌছি দুপুরের মধ্যে। সেখানে গিয়েই সন্ধ্যার বাসের টিকিট না পাওয়ায় পরের দিনের ভোরের টিকিট কেটে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের এ পাশ-ওপাশ ঘুরে হোটেলে ফিরি। পাহাড়ি এলাকা বলে সন্ধ্যার মধ্যে প্রায় সব দোকান-পাট বন্ধ হয়ে যায়।
পরদিন ভোরে উঠে ১৪ সিটের মাইক্রোবাসে ৫০০ টাকা টিকেটে চেপে বসি। তবে এখান থেকে ভালো মানের বাসও রয়েছে। বাস ভাড়া মাত্র ৩ শত টাকা। বেলা ১০ টায় আসামের পাইকান এবং দুপুর ১ টায় গোয়াহাটিতে প্রায় ১ ঘন্টা সময়ের পৃথক দুইটি স্টপেজ দিয়ে বিকেল ৩ টার মধ্যে শিলং শহরে পৌছে যাই। সেখানে পৌছে হোটেল সন্ধানে বেশ সময় লেগে যায়। কারণ শিলং শহরে পুলিশ বাজার এলাকায় বিদেশীদের রাত্রী যাপনের অনুমোদন সব হোটেলে নেই। তাই ঘুরে ঘুরে বেশ কয়েকটি হোটেল দেখে অবশেষে একটি হোটেল পেয়ে যাই। এ হোটেল খুজতেই সন্ধ্যা হওয়ায় কোথাও বেড়ানো সম্ভব হয়নি।
তবে সন্ধ্যায় পুলিশ বাজারের চৌরাস্তা মোড়ে জম্পেশ আড্ডায় মেতে উঠে স্থানীয় এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত পর্যটকরা। এসময় পাহাড়ে গাঁ থেকে হিমেল হাওয়া মনকে অন্যরকম শিহরণ জাগায়।
পরের দিন সকাল ৮ টার মধ্যে বেড়িয়ে পরি। তুরার এক গারো বন্ধুর সহযোগীতায় শিলং এর মাইকেল নামে এক এক্স এমএলএ’র প্রাইভেট কারে ছুটে চলি মেঘ-বৃষ্টির খেলা দেখতে চেরাপুঞ্জি’র উদ্দেশে। কিন্তু মাইকেল ভাই এর অপর সঙ্গী স্থানীয় ব্যবসায়ী ফ্রান্সিস ভাই নিয়ে যায় বাংলাদেশের ডাউকি সীমান্তের কাছে। সেখানে গাছের উপর একটি স্পট রয়েছে ‘বাংলাদেশ পিক’। সেখানে উঠে বাংলাদেশের সিলেটের তামাবিল দর্শন করে দেশের স্বজনদের সাথে মোবাইলে কথা বলি। ওই বাংলাদেশ পিকে উঠে মজার দৃশ্যের পাশপাশি দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যাওয়াটি এক অনন্য অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কাজ করে।
এরপর চলে আসি এশিয়ার মাহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন গ্রাম খাসিয়া পল্লী ‘মাওলিননং’ এ। সেখান থেকে ট্রি ব্রীজ। অর্থাৎ প্রাকৃতিক ভাবে একটি ঝর্নার উপর গ্রাছের মূল ছড়িয়ে তৈরী হয়েছে ব্রীজ। সে ব্রীজ দিয়ে পারাপার এবং ব্রীজের নিচে ছুটে চলা ঝর্নার কলকল শব্দ অদ্ভুদ এক অনুভুতি। তবে সেখানে যেতে হলে অনেক কষ্ট করতে হবে। কারণ ওই ঝর্নার কাছে যেতে কমপক্ষে একশত ফুট নিচে নামতে হবে সিড়ি বেয়ে। আবার উঠতে হবে ওই পথেই।
এই লম্বা ভ্রমনের পথে মাঝে মধ্যে মেঘ যখন আমাদের গাড়ির উপর আছড়ে পড়ছিল তখন নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি আমরা কেউই। গাড়ি থেকে বেড়িয়ে একে মেঘ ধরার প্রতিযোগীতায় নেমে পড়ি। আমরা যেভাবে এদেশে মেঘ দেখি ওখানে ওই মেঘ সে রকম নয়। অনেকটা কুয়াশার মতো দেখা যায়। সে কুয়াশা মেঘ হয়ে আলতো করে যখন আমাদেরকে ছুয়ে গিয়ে ভিজিয়ে দিল তখন মনে হলো এ যেন স্বর্গের পরশ।
সেদিন আমাদের কপাল মন্দ ছিল। সব ভ্রমন শেষ করে বিকেলের দিকে চেরাপুঞ্জির উদ্দ্যেশে যাত্রা করতেই বাঁধ সাধে ঘন মেঘ আর বৃষ্টি। এ ধরনের ঘন মেঘ সবসময় দেখা না মিললেও যখন দেখা মিলে তখন তুমুল বৃষ্টিতে রাস্তা অতিক্রম করা খুবই ভয়ানক বিষয়। তাই আমরা চেরাপুঞ্জির মূল পয়েন্টের মাত্র ২ কিলেমিটার কাছ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হই।
তবে মজার বিষয় হলো, মাত্র ৫/৬ কিলোমিটার দুরত্বে আসতেই মেঘ চলে যায় এবং দুর পাহাড়ে সূর্যের হাসি দেখতে পাই। আবার কিছু দুর এগুতেই ফের বৃষ্টির মুখে পড়ি। এই মেঘ, এই বৃষ্টি এবং এই রোদ্দুর, সবমিলিয়ে সে এক অন্যরকম অনুভূতি এবং অন্যরকম শিহরণ জাগিয়েছিল আমাদের।
অবশেষে সন্ধ্যার ঠিক আগ মূহুর্তে ফিরে আসার কারণে শিলং এর আকর্ষনীয় ‘শিলং পিক’ দেখা হলো না। তাই সর্টকাট সময়ের মধ্যে এলিফেন্ট ফলস্ বা হাতির ঝর্না দেখে তুরার উদ্দ্যেশে শিলং থেকে সন্ধ্যার বাসে চড়ে বসি এবং ভের ৪ টায় তুরা শহরে এসে ওই স্থানীয় গারো বন্ধু’র বাসায় উঠি। সেখানে একটি লম্বা ঘুম দিয়ে পরদিন দুপুরে উঠে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তুরার বিভিন্ন স্থান দর্শন এবং সামান্য কিছু কেনাকাটা করে আবারও ফিরে যাই ওই বন্ধুর বাড়িতে। সেখানে রাত্রিযাপন করে পরের দিন সকাল বেলা মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে বাংলাদেশ সীমান্তের নাকুগাঁও হয়ে নিজের শহরে পৌছি বেলা ২ টার মধ্যে।
ঢাকা থেকে মেঘালয় বা শিলং যাওয়ার সহজ উপায় হলো ঢাকা থেকে সিলেট। তারপর সিলেটের তামাবিল সীমান্ত দিয়ে মেঘালয় রাজ্যে প্রবেশ করা যায়। তবে বৃহত্তর ময়মনসিংহবাসীর জন্য শেরপুরের নাকুগাঁও-ঢালু হয়েই শহজ ও রোমাঞ্চকর পথ।
কিভাবে যাবেন : বাংলাদেশের সিলেট জেলার তামাবিল সীমান্ত থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দুরে শিলং শহর। এছাড়া বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলাবাসীর জন্য নতুন একটি রুট হয়েছে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার নাকুগাঁও-ভারতের ঢালু সীমান্ত দিয়ে। এ সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তরে মেঘালয়ের তুরা শহর। সেখান থেকে সকাল ও রাত্রে আসামের পাইকান-গোয়াহাটি হয়ে শিলং যাওয়ার চমৎকার রাস্তা নির্মান হয়েছে। এ সীমান্ত দিয়ে শিলং এর দুরত্ব প্রায় ৩ শত কিলোমিটার হলেও তুরা, পাইকান, গোয়াহাটি হয়ে মেঘ-পহাড়ের অপরূপ দৃশ্য দেখা বাড়তি আনন্দ দেবে ভ্রমনকারীকে।
কখন যাবেন : মেঘালয়ে সারা বছর পর্যটকদের আগমন ঘটে তবে সেখানে পিক সিজন ও অফ পিক সিজন হলো মার্চ মাস থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি এবং সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি। পিক সময়ে শিলং এর আসল রূপ দেখা যায়। বিশেষ করে হাত দিয়ে মেঘ ছোয়া, এ সময় প্রচুর পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন। তাই সবকিছুর দাম বেশি থাকে। যেমন ভ্রমণ খরচ, হোটেল ভাড়া, খাবার খরচ এ সময় অন্য সময়ের চেয়ে বেশি।
কোথায় থাকবেন : শিলং শহরে পর্যটকদের থাকার হোটেলগুলোর অধিকাংশই বড়বাজার ও পুলিশ বাজার কিংবা তার আশপাশে অবস্থিত। তবে পুলিশ বাজার তাদের কাছে বেশি জনপ্রিয়, কারণ এখান থেকে থেকে সহজেই বিভিন্ন টুরিস্ট স্পটগুলোতে যাওয়ার গাড়িগুলো ছেড়ে যায়। শিলংয়ের হোটেলগুলোতে আপনি দিন প্রতি ৮০০ রুপি থেকে ১০ হাজার রুপির মধ্যে রুম পাবেন। শিলংয়ের হোটেলগুলোর মধ্যে অন্যতম হোটেলগুলো হলো ইডেন রেসিডেন্সি, হোটেল ব্রডওয়ে শিলং, হোটেল আলপিন কন্টিনেন্টাল, দ্য মাজেস্তিক হোটেল ইত্যাদি।
যেসব খাবার খাবেন : শিলংয়ে বেশ ভালো কিছু খাবারের হোটেল রয়েছে। এ হোটেলগুলোতে মাছ, মাংস, লুচিসহ নানা দেশীয় এবং চায়নিজ খাবার পাওয়া যায়। তবে যাঁরা হালাল-হারাম চিন্তা করে খাবার খেয়ে থাকেন, তাঁরা একটু যাচাই বাছাই করে খাবেন। কারণ খাসিয়াদের অন্যতম প্রিয় খাবার হচ্ছে শূকরের মাংস। তবে শিলংয়ের কিছু খাবার খুব জনপ্রিয়, যার স্বাদ আপনিও গ্রহণ করতে পারেন যেমন পুলিশ বাজারের দিল্লি মিষ্টান্ন ভান্ডারের জিলাপি, ইসি রেস্তোরাঁর কিমা সমুচা। এ ছাড়া এখানকার রেস্তোরাঁগুলোর চাউমিন বেশ প্রশংসিত।
যেসব জায়গায় বেড়াবেন : পর্যটকদের মন হরণ করার মতো অনেক দর্শনীয় স্থান এখানে রয়েছে। শিলং এর কিছু দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম হলো, মাউলিংনং ভিলেজ, ডাবল ডেকার জীবন্ত সেতুর ব্রিজ, এলিফ্যান্ট ফল্স, বালপাকরাম ন্যাশনাল পাক, ইউমিয়াম লেক, মাউসমাই গুহা, সিজু গুহা, নহখালিকাই ফলস ও সেভেন সিস্টার্স ফলস ইত্যাদি। আমরা যদিও সংক্ষিপ্ত ভ্রমন এবং সময়ের কারণে উল্লেখিত স্থান ছাড়াও আরো অনেক দর্শনীয় স্থান পরির্দশন করতে পারিনি। তবে শিলং কে পরিতৃপ্ত ভাবে দেখতে চাইলে অবশ্যই ৭ দিনের ট্যুর হওয়া চাই।
দর্শনীয় স্থানগুলোতে যেভাবে যাবেন : পুলিশবাজার মোড় থেকে আপনি এই স্থানগুলোতে যাওয়ার বিভিন্ন গাড়ি পাবেন। এছাড়া এখান থেকে প্রতিদিন বাসে করে কম খরচে পর্যটকদের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে দেখানো হয়। তবে এর জন্য আপনাকে আগে থেকে টিকেট কেটে রাখতে হবে। এ ছাড়া আপনার সুবিধার জন্য সঙ্গে একজন টুরিস্ট গাইড রাখতে পারেন।
সঙ্গে যা যা রাখবেন : একজন টুরিস্ট হিসেবে আপনার প্রথমেই যা সব সয়য় সঙ্গে রাখা উচিত তা হলো আপনার পাসপোর্ট ও ভিসা। কারণ পুলিশ যেকোনো সময় যে কোন স্থানে আপনার পাসপোর্ট ভিসা দেখতে চাইতে পারে। এ ছাড়া যেহেতু মেঘের রাজ্য, সুতরাং ভিজতে না চাইলে অবশ্যই কিছু সরঞ্জাম যেমন ছাতা, রেইন কোর্ট, মোবাইল ভেজা থেকে রা করতে পলিথিন ব্যাগ ইত্যাদি সঙ্গে রাখুন। কিছু মানুষ আছে যাদের উঁচুতে উঠলে কানে তালা লাগাসহ মাথাব্যথা হয়। কাজেই মাথাব্যথার ট্যাবলেট রাখতে পারেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি হলো খাবার পানি সঙ্গে নিতে ভুলবেন না।
সাবধানতা : মেঘালয়ের স্থানীয় অধিবাসীরা পর্যটকদের প্রতি আন্তরিক হলেও কোনোভাবেই তাদের সঙ্গে বাকবিতন্ডায় যাবেন না, এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। যাঁরা হালাল-হারাম চিন্তা করে খাবার খেয়ে থাকেন, তাঁরা একটু দেখেশুনে খাবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে খাবার খাবেন। সকাল সকাল ঘুরতে বের হয়ে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ফিরে আসুন। সঙ্গে মোবাইল, ক্যামেরা ইত্যাদি থাকলে সেগুলো সাবধানে রাখুন।
লেখক : উপদেষ্টা সম্পাদক ও সাংবাদিক, শেরপুর টাইমস ডটকম।
মোবাইল : ০১৭১১-৪৪২৯২১, ০১৯১৮-৮৯৩৬২১