ঠিকানা
– রফিক মজিদ
ঘড়িতে সময় সকাল সাতটা দশ। রিক্সাওয়ালাকে বল্লাম ভাই একটু জোড়ে চল, সাড়ে সাতটায় ট্রেন, ধরতে না পারলে টিকেট মার। তখনও গুলিস্থানে। হাতে সময় মাত্র কুড়ি মিনিট। পৌছতে পারবো কি ? দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতেই কমলাপুর ষ্টেশনে পৌছলাম। সেইসাথে ট্রেনের হুইসেল পড়ছে। রিকসা ভাড়া দিয়ে ব্যাগটা নিয়ে দৌড়ে কোন রকমে ট্রেনের পেছনের বগিতে উঠে পড়ি। এরপর টিকেট বের করে কোচ নাম্বার দেখে দেখে সিট নাম্বার মিলিয়ে বসি জানালার পাশে। আমার সামনে ও পাশে পুরোটাই সিট খালি ছিল। তবে পাশের লাইলেন সিটে একটি মেয়ে জানালা ঘেষে বসে আছে, সাথে ছোাট্ট একটা ছেলে। সম্ভবত মেয়েটির ভাই। মেয়েটি হয়তো কলেজ পড়–য়া আর ছেলেটা ফোর কিম্বা ফাইভ এ পড়ে। তাদের সাথে কাউকে দেখতে পেলাম না।
কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে প্রকৃতিকে দেখলাম। ঘন কুয়াসা আকাশের নীল হনন করছে। ধানের শীষে শিশির বিন্দুতে রোদ এসে আঁছড়ে পড়ছে। কৃষক সবে মাত্র হাল ধরেছে। হঠাৎ দেখি গাছেল ডালে জোড়া শালিক। পাশের মেয়েটির দিকে তাকাই। ঠোঁট দু’টি হালকা কুয়াসা এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। কি নাম, কোথায় বাড়ি, কি করে কিছুই জানি না !
‘চা নাস্তা দেব’ হঠাৎ ট্রেনের খাবার গাড়ির বেয়ারার ভাষ্য। বল্লাম, নাস্তা না, শুধু চা। এরপর বেয়ারা মেয়েটিকে বলে, আপা চা-নাস্তা লাগবে। মেয়েটি মাথা নেড়ে না বোধন উত্তর দেওয়ায় বেয়ারা চলে গেলেন। মৃদু স্বরে বল্লাম, এসময় চা হলে ভালো লাগতো। এ কথা শুনে মেয়েটি বিরবির করে কি যেন বল্ল বোঝা গেলো না।
সময় পেরুচ্ছে ট্রেন ছুটছে। কিছুক্ষণ জানালার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ট্রেন ছুটছে শাল-গজারির বনের ভিতর দিয়ে দ্রুত গতিতে। আর আমার পাশে উড়ছে বিসৃত চুল, ফিন ফিনে উড়না। হাতে তার সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘আগামী’ আর আমার হাতে ‘এ শতাব্দির প্রেমের কবিতা’।
চা নিয়ে এলো বেয়ারা। এদিকে মেয়েটার ভাই বায়না ধরছে নাস্তা খাবে। মেয়েটি বোঝানোর চেষ্টা করছে এসব নাস্তা ভালো না। কিন্তু মানছে না ছেলেটি। চা শেষ করে বিলটা দিয়ে দিলাম। এসময় বেয়ারাকে বল্লাম ওখানে একটা নাস্তা দাও। কথাটা শুনে মেয়েটা রেগে মুখখানা হিং¤্র দানবের মতো করে বেয়ারার উদ্যেশে বল্ল, ‘লাগবে না বল্লাম’, একথা বলেই কি যেন একটু চিন্তা করে আবার বল্ল, ‘ঠিক আছে শুধু নাস্তা দাও’।
এরপর মেয়েটি আমার দিকে অগ্নিমুর্তি হয়ে তাকালো। তার তাকানো দেখে আমার চোখের পলক পড়ছে না দেখে লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নেয়। এসময় আমার চোখে ছিল সন্ধির প্রস্তার আর তার চোখে ছিল লজ্জার আভাস। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি ময়মনসিংহ জং লেখা। মনে মনে ভাবছিলাম এখানে যদি নেমে যায় নামটা অজানা থাকবে। সরাসরি জিজ্ঞেস করবো, না থাক দেখি কোথায় নামে, এসব কথা ভাবতেই দেখি ট্রেন ছেড়ে দিল। নাহ্ এখানে নামবে না। হয়তো সামনে কোথাও নামবে।
এরমধ্যে বেয়ারা এলো বিল নিতে। আমি বিল দিতে পকেটে হাত দিতেই, মেয়েটি বেয়ারাকে ডেকে বলে, ‘এই এদিকে, বিল আমি দিব’, সেই সাথে আমার উদ্যেশে বল্ল, ‘ধন্যবাদ আমার কাছে টাকা আছে’। কিছু মনে করলাম না। কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা।
ঝিক ঝিক ট্রেনের শব্দ আর দোলায় মেয়েটির চোখ বুজে যাচ্ছিল একটু পর পর। হয়তো ঘুম পেয়েছে। আমার চোখে ঘুম থাকলেও মেয়েটির চাওনি দেখে তা কেটে গেছে। এবার চোখ বুঝতেই ছেলেটিকে ইশারায় কাছে ডাকলাম। ছেলেটি কাছে আসতেই বল্লাম, ‘তোমার আপুর নাম কি ?’ সবে মাত্র ছেলেটি ক’ বলেছে, অমনি চিলের মতো ছো’ মেরে ছেলেটির মুখ চেপে ধরে তার পাশে বসিয়ে দিল।
ক’ দিয়ে হতে পারে কলি বা কল্পনা, নামটা জানা হলে ক্ষতি কি, সামনেই তো নেমে যাবো। কথাটা বলেই ফেল্লাম সাহস করে। কিন্তু কোন উত্তর নেই। অনেকটা পেছন ফিরে ছেলেটিকে ধরে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। কি আর করা। শুধু গন্তব্যে শেষ ঠিকানায় পৌছার অপেক্ষা করা ছাড়া করার কিছুই করার নেই আমার।
আমার গন্তব্য জামালপুর। সক্ষিপ্ত পথ। তাও মনে হয় চলে এসেছে। কিন্তু তার আগে যদি নেমে যায় ! ঠিকানা না পেলেও দু:খ নেই অন্তত নামটা জানতে পারলেও হতো। এসব নানা কথা চিন্তা করতেই আবারও জানালা দিয়ে দেখি জামালপুর জং লেখা। মনটা এবার ডুকরে উঠলো। এখন আমরা পাশাপাশি, একটু পর দু’জনের দু’রাস্তা। তাও আবার অজানা। মনটা ভিষন পীড়া দিয়ে উঠলো।
ট্রেনের গতি থামছে, আর আমার হৃদয়ের হার্ট বিট ক্রমেই বাড়ছে। ব্যাগ নিয়ে মেয়েটি উঠে দাড়ালো। আমারও উঠতে হবে। শরীর টা যেন পাথরের মতো ভারি হয়ে গেছে। উঠতে কষ্ট হচ্ছে। এবার গেইট দিয়ে মেয়েটি সোজা নেমে গেলো। হৃদয়ে বড় ছ্যাকা দিয়ে চলে গেলো কসাই মেয়েটি।
এ কথা ভাবতে ভাবতে সিট থেকে উঠতেই চোখ পড়লো মেয়েটির সিটের উপর একটি চিরকুট। বিদ্যুতের গতিতে তুলে নিয়ে পড়তে লাগলাম। ওতে লেখা,‘ আমি কলি বা কল্পনা কোনটাই নই। আমি কবিতা, ফোন-০১৭…..। সরকারী আশেক মাহমুদ কলেজ, জামালপুর।
লেখক : রফিক মজিদ,
কবি ও সাংবাদিক,
উপদেষ্টা সম্পাদক, শেরপুর টাইমস ডটকম।
(শেরপুর টাইমস ডট কমের “সাহিত্য পাতা” সকলের জন্য উন্মুক্ত। আপনার স্বরচিত ছড়া- কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য ইমেল করুন sherpurtimesdesk@gmail.com এই ঠিকানায়।)