শেরপুর জেলা পুলিশের উদ্যোগে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর জগৎপুর গণহত্যার স্মৃতিফলক হচ্ছে। মঙ্গলবার দুপুরে (১১ এপ্রিল) জগৎপুর গ্রামে শহীদ স্বজন ও গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে মতবিনিময়কালে পুলিশ সুপার মোঃ কামরুজ্জামান বিপিএম স্মৃতিফলক নির্মাণের ঘোষণা দেন। একই সাথে তিনি আগামী ৩০ এপ্রিল পুলিশের পক্ষ থেকে নানা আয়োজনে জগৎপুর গণহত্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্তের কথা জানান। এর আগে জেলা পুলিশের শীর্ষ এ কর্মকর্তা ওই গ্রাম ঘুরে দেখেন। এসময় হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ স্বজনরা সেদিনের গণহত্যার স্মৃতি তুলে ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। পুলিশ সুপার নিজেও সেদিনের নৃশংসতার ঘটনা শুনে আপ্লুত হন।
পুলিশ সুপার কামরুজ্জামান মতবিনিময়কালে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা জগৎপুরের মত সারাদেশে অসংখ্য স্থানে গণহত্যা সংগঠিত করে। এসব গণহত্যার স্থান ও ইতিহাস আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগ ও স্বজন হারানোর গল্প একদিন হারিয়ে যাবে। তাই ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে শহীদ স্মৃতি ফলক করা হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এসময় তার সাথে ঝিনাইগাতী থানার ওসি মোঃ মনিরুল আলম ভূইয়া, ধানশাইল ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ শফিকুর রহমান, শহীদ পরিবারের সদস্য সুভাষ চন্দ্র দে, শ্যামল চন্দ্র দে ও প্রত্যক্ষদর্শীরা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৩০ এপ্রিল শেরপুরের জগৎপুরে নৃশংস গণহত্যা চালায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদর বাহিনী। সেদিন ঝিনাইগাতী উপজেলার ধানশাইল ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম জগৎপুরের মাটি ও রঙ্গাবিল নিরীহ মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওইদিন শুক্রবার ছিল। সকালে বৃহত্তর ময়মনসিংহের আলবদর বাহিনীর প্রধান জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে বদর বাহিনী ও স্থানীয় রাজাকাররা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কে সাথে নিয়ে জগৎপুরে হানা দেয়। এর আগে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নিরাপদ স্থান ভেবে জসৎপুরে আশ্রয় নেয় টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও শেরপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক লোকজন। সকাল ৭টার দিকে গ্রামের তিনদিক ঘিরে ফেলে হানাদার বাহিনী। পরে মেশিনগান দিয়ে গুলি চালায়। আকস্মিক হামলায় হতভম্ব লোকজন এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে ঝাপিয়ে পড়েন রঙ্গা বিলে। প্রায় তিন ঘন্টার পৈশাচিক গণহত্যায় শহীদ হন প্রায় ১৫০ জন মানুষ। এরমধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য ছিল প্রায় ১০০ জন। মুসলিম সম্প্রদায়ের অর্ধ শতাধিক নিরীহ মানুষ সেদিন শহীদ হন। আহত হন ৬০-৮০ জন। মানুষের রক্তে রঙ্গা বিলের পানি লাল হয়ে যায়। স্বজনের লাশ রেখে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অনেক গ্রামবাসী আশ্রয় নেন ভারতের ঢালু, চিচিংপাড়া ও বারেঙ্গা পাড়ায়। সেখানে স্থানীয় হাসপাতালে আহতদের ভর্তি করা হয়।
এদিকে, বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শতাধিক ব্যক্তির মরদেহ শেয়াল, কুকুর ও শকুনের খাবার হয়। স্থানীয়দের মধ্যে মাত্র কয়েকজনের লাশ মাটি চাপা দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর ৩৭ জনের পরিচয় পাওয়া যায়। বাইরে থেকে ওই গ্রামে এসে যারা শহীদ হন তাদের হদিস আজও পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয় জগৎপুর গণহত্যার কোন বিচার হয়নি। সনাক্ত হয়নি শহীদের সংখ্যা, নাম ও পরিচয়। ওই গ্রামে নেই আজও নেই কোন স্মৃতিস্তম্ভ।