মুক্তিযোদ্ধে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন। অথচ আজো পাননি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। বলছি ৭৩বছর বয়সী নিন্দার সন মৃ। এটি এক বীর সৈনিকের নাম। তিনি যোগ দিয়েছেন পাক সেনাদের সন্মুখ যুদ্ধে। কখনো গরুর গাড়ি দিয়ে এনেছেন নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ। মুক্তিসেনাদের সাথে চলেছেন সমানতালে। খনন করেছেন ব্যাংকার। বহন করেছেন অস্ত্র-গোলা বারুদ। রকেট বোমা নিক্ষেপে তিনি ছিলেন পারদর্শী। রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে অনেকবারই পড়েছেন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে। নির্মম মৃত্যুর হাত থেকেও পেয়েছেন রেহাই।
তার জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্লভ স্মৃতিগুলো মনে পড়লে আজো আতঁকে ওঠেন। ফিরে যান সেই একাত্তরের আঙ্গিনায়। বলেন রক্তক্ষয়ি যুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত ঘটনাগুলো। দুর্ধষ বিজয়ের গল্প বলতেই তার দু’চোখ বেয়ে নেমে আসে জল। বিজয়ী এ সৈনিক এখন জীবন যুদ্ধে পরাজিত। বেদনা জড়িত কন্ঠে নিন্দার সন বলেন, স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখেছিলাম। অথচ আজো পেলাম না মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। সম্প্রতি একান্ত সাক্ষাতকারে শেরপুর টাইমসের প্রতিনিধি শাকিল মুরাদকে তুলে ধরেন এমনি আরো অনেক স্মৃতি বিজরিত ভয়ংকর ঘটনা।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ঘেঁষা শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তের খ্রিষ্টানপাড়া গ্রামের ক্ষুদ্র নৃতাত্তিক জনগোষ্ঠীর বাসিন্দা নিন্দার সন মৃ। বাড়িটি ভারতের নোম্যান্স এর কাছাকাছি পাহাড়ি টিলায়। তার বাবা সুরেন্দ্র মারাক। মা বিরনী মৃ। দু’জনেই মারা গেছে অনেক আগেই। তার ৭ ছেলে ২ মেয়ে। তারা দুই ভাই। চার বোন। ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। একাত্তুরে তিনি টেংগড়পাড়া উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র। পড়ালেখার পাশাপাশি বাবার সাথে গরুর গাড়ি চালাতো। এটা ছিল তাদের সংসারের আয়ের একমাত্র উৎস। রেডিও বেতারে একাত্তুরের ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ভাষন শোনেছেন তিনি।
এ সময় তার প্রতিবেশী অনেকে যোগদেন মুক্তিযোদ্ধে। তারা প্রশিক্ষণের জন্যে যান ভারতে মেঘালয়ের পোড়াকাশিয়ায়। তাদের সাথে তিনিও যান। তার বাড়ি থেকে বিএসএফের ক্যাম্পের দূরত্ব মাত্র ৪/৫কিলোমিটার। মাঝে মধ্যেই চলে আসতেন বাড়িতে। নিয়ে যেতেন গরুর গাড়ি। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে প্রশিক্ষণ করেন তিনি। পরে তাদের সাথে যান রক্তক্ষয়ি রনাঙ্গনে। গোবিন্দনাথ খিলা, ধানুয়া কামালপুর ও গাইবান্দায় কয়েকদিন সন্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। এসব স্থানে যারা পাক সেনাদের হাতে শহীদ হন তাদের মরদেহ গরুর গাড়ী দিয়ে নিয়ে আসেন তিনি। তাদেরকে সমাহিত করতেন তার বাড়ির পাশ্ববর্তী এলাকা রাঙাজানের বদ্ধ ভূমিতে। উঠতি বয়সের যুবক ছিলেন নিন্দার সন।
যেখানেই পাক সেনাদের অত্যাচারের খবর পেতেন সেখানেই ছুটে যেতেন তিনি। সবশেষে কর্ণঝোড়া এলাকায় ২ পাক সেনা আর রাজাকাররা যুবতী মেয়েদের ইজ্জত নষ্ট করতো। অনেকের ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। এ সংবাদ পেয়ে নিন্দার সন সহ যোদ্ধাদের সাথে যান সেখানে। অবশেষে ওই দুই পাকসেনাকে আটক করেন তারা। তাদেরকে কর্ণঝোড়া বট বৃক্ষের সাথে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। তবে তার জীবনের আরো ভয়ংকর দিন কেটেছে গাইবান্দায়। সেখানে সন্মুখ যুদ্ধে তিনি ছিলেন সামনের সাড়িতে। সারাদিন যুদ্ধের পর রাতে পাক সেনারা নদীতে নেমে পিছু হটে।
পরবর্তীতে আসেন কামালপুর এলাকায়। সেখানে চলে দফায় দফায় সন্মুখ যুদ্ধ। এসব যুদ্ধে কখনো বহন করেছেন অস্ত্র গোলা বারুদ। আবার কখনো নিজেই হয়েছেন যোদ্ধা। তার জীবনের শ্বাসরোদ্ধকর ঘটনা গুলো আজো তাকে বিচলিত করে তুলে।
তিনি এখনো কথা বলতেই হয়ে ওঠেন তেজোদীপ্ত। বলেন, পাক সেনাদের নির্মমতা বাংলার মানুষ কখনোই ভুলবেনা। তবে তার আক্ষেপ মুক্তিযোদ্ধে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করলাম। অথচ আজো পেলাম না মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। নিন্দার সন এখন বাড়িতে থাকেন। বয়সের ভারে অনেকটাই ন্যুইয়ে পড়েছেন। গারো নিয়মে সংসারে ছেলেরা চলে গেছে শ্বশুর বাড়ি। আছে ২ মেয়ে। তারা কৃষির ওপর নির্ভরশীল।
প্রত্যন্ত এ পাহাড়ি এলাকায় আয়ের তেমন কোনো উৎস নেই। তাই অনেক সময় দিন কাটান না খেয়ে। দারিদ্র্যতার নির্মম কষাঘাতে পড়েও কখনো হাত বাড়াননি। তিনি বলেন, কিছুই চাইনা। শুধু চাই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। যেন গর্ব করে বলতে পারি আমরা এ দেশকে স্বাধীন করেছি। নতুন প্রজন্ম যেন আমাদের স্বরণ করে। এটাই তার প্রত্যাশা।