॥ মো. শাহ্ জামাল ॥
৭১’সাল। যুদ্ধের সূচনাতেই জামালপুরের মেলান্দহের দাগি-বানিপাকুরিয়া-বেতমারী রেলওয়ে ব্রিজে পাকবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করে। মুক্তিবাহিনীরা দাগি-বানিপাকুরিয়া রেলওয়ে ব্রিজ ধ্বংশের মাধ্যমে প্রথম সফল অপারেশ করেন। এটি ছিল জামালপুর-শেরপুরের মধ্যে প্রথম অপারেশন। ঢাকার সাথে উত্তরবঙ্গের রেলপথ ছিল এটি। পাকসেনাদের ক্যাম্প নিরাত্ত্বার জন্য আশপাশের গ্রামগুলোর লোকদের রাতজেগে পাহারা দিতে বাধ্য করতো। বহু নর-নারীকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করতো এই ক্যাম্পে। এই অপারেশনে অংশগ্রহণকারী মেলান্দহের ফুলছেন্না গ্রামের আবুল হোসেন, ঘোষেরপাড়ার আব্দুল কদ্দুস এবং ইসলামপুরের মানিকুল ইসলাম মানিক কমান্ডার জানান-তাদের সাথে অন্যান্য যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হলেন-মেলান্দহ শাহাজাতপুরের মজিবর ফারাজী, ঘোষেরপাড়ার আসাদুল্লাহ কমান্ডার, জামালপুর চন্দ্রার আলম এবং দিগপাইতের রইচ উদ্দিন।
এদের মধ্যে সদ্য বীর খেতাব ও গার্ড অব অনার বর্জনকারী হিসেবে সারাদেশের এখন আলোচিত ব্যক্তি।
সেই যোদ্ধা আবুল হোসেন বলেন-৭মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর আমি ও মজিবর রহমান ফারাজী যুদ্ধে যাবার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই। ১২মে বাড়ি থেকে বের হন। ১৭মে ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জে রিক্রুট হয়ে ৩৮দিন ট্রেনিং করেন। ২৫জুন/৭১ উচ্চতর প্রশিক্ষিত আলমসহ আরো কয়েকজন ৭জনকে বাছাই করলেন। যুদ্ধের রসদ নিয়ে মহেন্দ্রগঞ্জ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ডিগ্রিরচর থেকে ব্রহ্মপূত্র নদীপথে ৩দিনের চুক্তিতে নৌকাভাড়া করেন। পথিমধ্যে ক্ষুধার্ত অবস্থায় গোয়ালেরচরে নোঙ্গর করেন। মজিবর ফারাজী, আলম খাদ্যের সন্ধানে গ্রামে ঢুকে পড়েন। বাকিরা নৌকা পাহারা দেন।
এলাকাবাসি নৌকা লুটের প্রস্তুতি নেয়া হয়। উপায়ন্তর নাপেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নৌকা নদীর মাঝ পথে নিয়ে বন্দুক উচিয়ে জনতাকে ভয় দেখান। এসময় মজিবর ফারাজী ও আলমকে নদীর দিকে আসতে দেখেন। তারা মজিবরদের উপর হামলা করতে পারে এই ভেবে জনতাকে বলেন, আমরা মুক্তিযোদ্বা। এ কথা শোনারপর গ্রামবাসিদের ভূলবুঝার অবসান ঘটে। আলম ও মজিবর নদীর কিনারায় আসলে নৌকা ভিড়ান। আধাসেদ্ধ মিষ্টি আলু খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করেন। মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় পেয়ে এলাকাবাসি সহযোগিতার হাত বাড়ান। সেখান থেকে নদীপথে বালুরচরের আব্দুল্লাহর বাড়িতে বসে রাতেই ব্রিজ ভাঙ্গার প্ল্যান করেন।
পরদিন মেলান্দহ পৌঁছে তৎকালীণ আ’লীগের সেক্রেটারী মালঞ্চ’র আলহাজ রুস্তম আলী ঠিকাদারের সাথে ব্রিজ ভাঙ্গার শলাপরামর্শ করেন। আবুল, আলম ও মজিবর ফারাজী ছদ্মবেশে ব্রিজের উত্তরে ঘুন্টিঘরের পাশে বৃহত জামগাছে ওঠে রেখি করেন। ২৭জুন/৭১ মধ্যরাতে সাধুপুর হয়ে ব্রিজের পূর্ব পাশ দিয়ে ব্রিজে প্রবেশ করেন। ব্রিজ ও রেলপথ রক্ষায় পাকবাহিনীরা এলাকাবাসিদের ধরে নিয়ে পাহারা দিতে বাধ্য করেছে। ওই সিভিল পাহারাদারদের হাতে তারা ধরাপড়ার পর ৭জনই অস্ত্র উচিয়ে মুক্তিফৌজ পরিচয় দেন। এ সময় পাহারাদারদের একজন মজিবর ফারাজীকে চিনে ফেলেন। পাহারাদাদের কেও পানি সাতরে চলে যায়। আবার কেও আমাদের বোমাপোতার সুযোগ করে দিতে সটকে পড়েন।
ব্রিজ এলাকায় পাথর আর পাথর। বোমা পোতার জন্য ৩-৪ফুট গর্ত করতে হয়। পাথরের মধ্যে গর্ত করতে কুদাল ভেঙ্গে যায়। তখন মজিবর ফারাজীর হাতে থাকা ডেকার (চাকু) দিয়ে ৪টি গর্ত করা হয়। এ সময় রাতের অন্ধকারে রইচ এগিয়ে আসলে তার পায়ে ডেকারবিদ্ধ হয়। গামছা দিয়ে তার পা বেধে নৌকায় রাখা হয়। একইসাথে ৪টি বোমা পুঁতে রাখা হয়। একটি বোমা ফোটে বাকিগুলো মিসিং হয়। শত্রুক্ষের কোন সাড়া নাপেয়ে কিছুক্ষণ পর একই সাথে ৩টি বোমা ফোটানোর বিকট শব্দে-ভয়ে নৌকার মাঝি পানিতে পড়ে যান। তাকে উদ্বার করে জীবনের ঝুকি নিয়ে ৭মুক্তিফৌজ দ্রুত সটকে পড়েন। অপারেশন শেষে পালিয়ে বাঘাডোবা মিয়া বাড়ির এবিএম সিদ্দিক ওরফে সুলতান মিয়ার বাড়িতে রাত কাটান।
আবুল স্মৃতিচারণে বলেন-পরদিন ২৯জুন/৭১ সকালে কবুতর ভাজি দিয়ে নাস্তা করি। এরপর হাটুরেদের সাথে মিশে পায়ে হেঁটে তারা ভারতের পৌছার পর বিএসএফ’র ক্যাপ্টেন ধন বাহাদুর আমাদের ৭জনকে হাবিলদার নিয়োগীর নেয়া হলে; নয়োগী বলেন-তোমাদের কৃতিত্বের সংবাদ বিবিসি-স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচার হয়েছে।
ব্রিজ ধ্বংশের পর এই এলাকায় অত্যাচার-নির্যাতন-বাড়িবাড়ি অগ্নিসংযোগ-হত্যার মাত্রা বেড়ে যায়। বানিপাকুরিয়া ডা. আ: সামাদের বাড়ি ও মেডিসেন ডিসপেন্সারী পুড়ে দেয়। কারী আ: ওয়াহাব, নিহন আলী, দাগি গ্রামের নবীন মোল্লা, আ: আজিজ মাস্টার, আনোয়ার হোসেন আনারসহ বহু মানুষকে নির্যাতন করে। মালঞ্চ’র মু্িক্তযোদ্ধা আ: করিমের পিতা শমসের মন্ডল, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকারাখার দায়ে ডাক্তার মুকুন্দ লাল সরকারের বাড়ি লুট ও আগুনে পুড়ে দেয়।
এইক গ্রামের আ: মজিদ চেয়ারম্যানকে নাপেয়ে তাঁর বছর বান্ধা কামলা ওমর আলীকে ধরে নিয়ে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয়। বেতমারীর নজিম উদ্দিন মেম্বারসহ অনেককেই নির্যাতন করে। নয়াপাড়ার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও তৎকালীন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী আলহাজ রুস্তম আলী ঠিকাদারকে গ্রেপ্তারের জন্য বাড়ি ঘেরাও করে। এ সময় রুস্তম আলী জরাজীর্ণ ল্যাট্রিনে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন।
একই সময়ে বানিপাকুরিয়া গ্রামের দু’সহোদর ওমর আলী-সৈবালিকে ক্যাম্পে বন্দি করে। সেখান থেকে কয়লা ইঞ্জিনে বেধে দেওয়ানগঞ্জে নিয়ে যায়। সেখানে সন্ধ্যায় দু’ভায়ের সামনে জীবন্ত একজনকে জ্বলন্ত কয়লা ইঞ্জিনে ফেলে হত্যা করে। এরপর দুই ভাকে পুড়ে মারার জন্য ড্রাইভারকে পাহারাদার হিসেবে রাখা হয়। এমতাবস্থায় ভ্রাতাদ্বয় বেসামাল হয়ে পড়েন। সম্ভবত ড্রাইভার ছিলেন। এই বাঙ্গালী ড্রাইভার দুই ভাইকে পালিয়ে আসার সুযোগ করে দেন। ওদিকে ওমর আলীর কুলের শিশু শাহ্ জামালকেও মায়ের কাছ থেকে কেড়ে ক্যাম্পে নিয়ে পাথরে নিক্ষেপ করে। এ সময় শিশুর মা-সালেহা বেগম, দাদি হাজিরণ বেওয়া এবং বড় বোন রমিছা খাতুন অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান।
পরে একই গ্রামের দিনমজুর জালাল উদ্দিনের সহায়তায় শিশুকে উদ্ধার করে মায়ের বুকে ফেরত পেয়ে মায়ের জ্ঞান ফিরলেও; দাদি-বোন চির বিদায় নেন। মৃত্যুর শোকে আকাশ-বাতাস ভারী করে তোলে। অপরদিকে বাঙ্গালী ড্রাইভারের সহায়তায় রাতের অন্ধকারে দুই ভাই ভোরে বাড়িতে এসে এ নির্মম মৃত্যুর শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। এমন পরিস্থিতি শব্দ করে কান্নাকাটি করারও সাহস ছিল না। কাফনের কাপড়ের অভাবে তাঁদেরকে কাঁথামোড়া দিয়ে দাফন করা হয়।
-লেখক-ইত্তেফাক সংবাদদাতা-মানবাধিকার কর্মী ও প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি মেলান্দহ রিপোর্টার্স ইউনিটি, জামালপুর। ০১৯১২১৮৫০৬২। #