সিলেট বিভাগের লোকজন অলস বেশি তা নতুন করে লেখার কিছু নেই। সকাল শুরু হয় ০৯-১০ টায়। আমরা প্লান করি সকাল ০৭ টায় সবাই বড়লেখায় উপস্থিত থাকবো।
কিন্তু যা হলঃ ০৬.৫৭ মিনিটে আমার ঘুম ভাঙ্গল, ফোন দিলাম একজনকে। তিনি আমার ফোনে জাগ্রত হয়ে বাকিদের জাগিয়ে তুললেন। ফ্রেস হয়ে কাটালতলীতে তাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। ০৮.৫০ কাটালতলীতে আমরা সবাই একত্রে মিলিত হয়ে গালে পান দিয়ে ৯.০০ টায় যাত্রা শুরু করিলাম। আমরা কাতালতলী থেকে জুড়ী – কুলাউড়া – ব্রাম্মন বাজার – শমশের নগর সিএনজিতে গ্যাস ভরে – ভানুগাছ – মাধবপুর হয়ে কলাবনপাড়া পৌছাই, অবশ্য গ্যাসের জন্য ১ ঘন্টার মত লেট হয়ে যায়। তখন বেলা ০১.৩০ মিনিট রাজবাড়ী ফরেস্ট এর মধ্য কাপড় পরিবর্তন করে হালকা নাস্তা করে যাত্রা শুরু।
গাইড ছাড়া অবিরাম হেটে চলা, যেহেতু দেড়- দুইঘন্টা হাটা লাগবে সেহেতু খুব জোরে কিংবা আস্তে হাটা উচিত না। আমরা হেটে চলছি, আগেরবার যখন যাই তখন লোকদের খুব আনাগোনা ছিল না। চলার জন্য কোন সুযোগ সুবিধা ছিলনা। গাইড ছাড়া রাস্তা চেনার কোন উপায় ছিল না। এখন স্থানীয়দের কল্যানে পর্যটকদের টিলা উটা নামার সুবিধার্তে বাশ বেধে সাঁকো এর মত করা হয়েছে। যাতে বাশে ধরে উপরে উটতে নামতে কষ্ট কম হয়। মাঝে মাঝে বসে বিশ্রাম নেয়ার জন্য বাশ দিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোথাও কোদাল দিয়ে মাটি কেটে সিড়ি করে দেয়া হয়েছে। ধন্যবাদ তাদের সহযোগী মনোভাবাপন্ন কাজের জন্য।
স্থানীয় এক গাইড এর কাছ থেকে জানলাম এই কাজগুলো তারাই করেছে। ০৩.১০ মিনিটে আমরা হামহাম ঝর্না পৌছলাম। এতদূর থেকে এত কষ্ট করে আসা গা না ভেজালে কি তৃপ্তি মিটে…? ঝাপাঝাপি সেলফিবাজি শেষে নাস্তা সারলাম। স্থানীয় এক হোটেলে চা খেলাম রং চা কাপ ১০ টাকা, ডিম ২০ টাকা। হোটেল এর মালিক এর কাছ থেকে রাস্তার ডিরেকশন নিয়ে ০৪.০০ টার দিকে সিতাপ ঝর্নার উদ্দেশ্যে ট্রেইল শুরু। অজানা অচেনা দুর্গম পাহাড়ে এগিয়ে চলছি আমরা। বিরামহীন চলতে থাকা, কোথাও হাটু পানি কোথাও হাটু পর্যন্ত কাদা, কোথাও শুধু বন আর বন চারদিকে গাছ পালা বেস্টনী করে রেখেছে আকাশ দেখা যাচ্ছেনা। ঝিরিপথের কোথাও বুক পর্যন্ত পানি। বার বার বিশ্রাম নেবার ইচ্ছা থাকলেও তা নেওয়া হচ্ছেনা সময়ের অভাবে। কোথাও ঝিরিপথের পাশ দিয়ে পাথরের গায়ে পাহাড়ের আধিবাসীদের যাতায়াত এর জন্য তারা কোন রকম পা ফেলার মত গর্ত করে রেখেছে। বৃষ্টির কারনে তাও আরও দিগুন পিচ্ছিল হয়ে আছে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে ক্ষুধার্ত আমরা এগিয়ে চলছি। সাবধানতা অবলম্বন করেই চলতে থাকি একটু অসাবধানতা হলে ঘটে যেতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা।
অপুর্ব সৌন্দর্য মন্ডিত ঝিরিপথে কিছুক্ষন পর দেখা মিলে সিতাপ ঝর্না ও হামহাম ঝর্না থেকে আসা পানির মিলিত স্থান। যেখানে বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বড়শী দিয়ে পাহাড়ে বসবাসকারী খাসিয়া আধিবাসীরা মাছ মারছে। তাদের কাছ থেকে রাস্তার লোকেশন জেনে চলতে থাকি। আমাদের সাথে আসা নতুন সঙ্গী বারবার মনোবল হারাচ্ছেন। একদিকে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে সাথে রাস্তা চেনে এমন কেউ নেই। বলতে থাকেন- অজানা পথে কতক্ষন হাটা যায়? হতে পারে আমরা ভুল পথে যাচ্ছি, আসুন ফিরে যাই। এরকম বিভিন্ন কথা বলতে থাকেন,… আমরা সাহস দিয়ে যাচ্ছি বারবার। কিন্তু আমরা কি করে ফিরে যাই? যত রাত হোক না কেন একবার এসে কি ফিরে যাবো? তা তো হয় না…যে করেই হোক লক্ষ্যে পৌছাতেই হবেই… সন্ধ্যা ০৬.০০ টায় আমরা সিতাপ ঝর্নায় পৌছাই। ঝর্না দেখে ভুলে যাই আমাদের ফিরতে হবে, অনেক কষ্টের পর সাক্ষাৎ স্মরণীয় করে রাখতে ক্যামেরায় বন্দি হলাম এক এক করে সবাই। মিনিট বিশেক কাটানোর পর মনে পড়ে বাড়ি ফেরার কথা… তাড়াহুড়া করে ফিরতে শুরু করলাম। আমি সিওর এই টাইমে কোন পর্যটক গাইড ছাড়া পাহাড়ী দুর্গম রাস্তায় সিতাপ ঝর্না দেখার ইচ্ছে পোষণ করবেনা। পা পিছলে পড়ে গেছি অন্তত ১০-১৫ বার। ভাগ্য ভালো বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি। ক্ষুধার্ত অবস্থায় অন্ধকারে পাহাড়ি দুর্গম রাস্তা পারাপার যে কতোটা কষ্টের তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাই। জোঁক রক্ত ইচ্ছেমত খেয়ে পড়ে যাচ্ছে দেখার মত সময় নেই, একটাই লক্ষ্য কিভাবে লোকালয়ে পৌছা যায়। কখনো পলি মাটিতে কখনো কাদায় কখনো পানি হাঁটু পর্যন্ত পা ঢুকে জুতা বার বার স্লিপ করতে থাকে। অবশেষে আমরা যখন লোকালয়ে পৌছাই ঘড়িতে ৭ টা বাজে… স্বস্থির নিঃশ্বাস ত্যাগ করি। পেঠের ক্ষিধায় অবস্থা এমন যা সামনে পাবো তা খেয়ে ফেলবো। কলাবাগান পাড়ার এক দোকান থেকে কলা কিনে আনেন সাইদ ও হানিফ ভাই। সমস্থ শরীরে আমাদের কাদামাখা, বৃষ্টির কারনে ফেরার পথে সি.এন.জি বারবার আটকে গেলে দক্ষ ড্রাইভার থাকায় ফিরে আসতে সক্ষম হই। রাস্তায় একটি মসজিদের পুকুরে গোসল করে চলতে থাকি আবার। লোকালয়ে গিয়ে দেখি একেকজনের শরীরে ছোট বড় ৫-৭ জোক। জীবনে প্রথম দেখলাম মাথায় জোঁক ধরে, সাইদ ভাই রাসেল ভাইদের মাথায় কানের পাশে জোকে ধরেছে। পায়ের কোন কোন যায়গায় জোক রক্ত খেয়ে পড়ে গেছে, অবিরাম রক্ত ঝরছে। সব শেষে সে এক অন্যরকম অনুভুতি যা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। ব্যতিক্রম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমাদের এই রুমাঞ্চকর ভ্রমণ শেষ করি…— যা কখনোই ভুলার নয়। |