চোক্কের (চোঁখের) সামনে পাহাড়ি ঢলের পানি সব কিছু ভাসাইয়া নিয়া গেল, কিছুই রাখতে পারলাম না। প্রবল স্রোতে বাড়িঘর লন্ডভন্ড কইরা দিছে, এহন মাইনষের বাড়িতে থাকি। আমরা গরীব মানুষ টাকা পয়সা নাই কিভাবে নতুন বাড়ি বানামু বা ঘরবাড়ি মেরামত করমু ভেবে পাইতাছি না।
এভাবেই কান্নাজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী বাতকুচি আটভাইপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সাজেদুল ইসলাম (৩৫)। তিনি চেল্লাখালী নদীর পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে নিঃস্ব অসহায় পড়ে পড়েছেন। লোড আনলোড শ্রমিকের কাজ করে একমাত্র কন্যা ও স্ত্রীসহ তিনজনকে নিয়ে কোনমতে সংসার পরিচালনা করে আসছিলেন সাজেদুল। বর্তমানে তিনি ঘরবাড়ি হারিয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তার বাড়ির দুটি ঘরই ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে পাহাড়ি ঢল। এবারের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা বাতকুচি আটভাইপাড়া গ্রামটি লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। ক্ষতবিক্ষত হয়েছে এই গ্রামের বেড়িবাঁধ। ঢলের পানি নেমে যাওয়ার পর এসব ক্ষত চিহ্ন ভেসে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এই গ্রামটি।
একটানা ভারি বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের স্রোতের তোড়ে পাশ দিয়ে বয়ে চলা চেল্লাখালী নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে এই বাতকুচি আটভাইপাড়া গ্রামের শুধু সাজেদুল নয় সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন এই গ্রামের হযরত আলী, আব্দুর রাজ্জাক, বাসেত আলী, আবদুল মান্নান, আবদুল আলিম, হাবিল উদ্দিন, হাফিজুর রহমান, সাবিজুর রহমান, হাসিনা বেগম ও আলাল উদ্দিন। আচমকা নদীর স্রোতের তোড়ে ভেসে যায় এসব পরিবারের ঘরবাড়ি ও পুকুরের মাছ। এমনই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে নদীর ওপারের বাতকুচি নামাপাড়া গ্রামেও। সেখানেও ভয়াবহ অবস্থা।
নিঃস্ব সাজেদুল ইসলাম বলেন, গত শুক্রবার (৪ অক্টোবর) সারারাত ভারি বর্ষণ হয়। ওইদিন ভোর বেলায় গ্রামের কেউ ছিলেন ঘুমে কেউবা আবার সবেমাত্র বিছানা ছেড়েছেন। সারারাতের ভারী বর্ষণ ও উজানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে থেকে উঁচু হয়ে প্রবল বেগে ধেয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে চেল্লাখালী নদীর দুইকুল উপচে বাতকুচি আটভাইপাড়া গ্রামে প্রবেশ করতে থাকে। এসময় গ্রামের যুবক বৃদ্ধরা মিলে বেড়িবাঁধ রক্ষা করতে মাটি ফেলতে থাকেন। কিন্তু হঠাৎ করে জলোচ্ছাসের মতো বিরাট উঁচু এক ঢেউ এসে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রবল স্রোতের তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তীরবর্তী বাড়িঘর। চোঁখের সামনের আসবাবপত্রসহ সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মহুর্তের মধ্যেই বেঁচে থাকার স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায় গ্রামবাসীর। তখন গ্রামের সকলে ঘরবাড়ি ছেড়ে মা বাবা ও স্ত্রী সন্তানাদি নিয়ে জীবন বাঁচাতে চলে যান পাশের উঁচু বারোমারী -শেরপুর মহাসড়কে। কেউবা চলে যান আশপাশের গ্রামের উঁচু বাড়িতে। পরের দিন শনিবার থেকে ঢলের পানি নেমে গেলে বাড়ি গিয়ে দেখেন সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। এই গ্রামের কমপক্ষে ১২টি পরিবারের বাড়িঘরের কোন অস্তিত্ব নেই। বেশির ভাগ বাড়ির সবগুলো ঘরে উপরে পড়ে গেছে। ঘরের আসবাবপত্র ও পুকুরের মাছ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। স্রোতের তোড়ে মাটি সরে গিয়ে বাড়ির আঙ্গিনা পুকুর হয়ে গেছে। ভেঙে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে গ্রামে যাওয়া বেড়িবাঁধটি।
পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্থ ওই গ্রামের হাবিল উদ্দিন (৬৫) বলেন, আমার জীবনে এমন পাহাড়ি ঢল আর দেখি নাই। আমরা নদীর পাড়ের বাসিন্দা পানি দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু এ বছর এতো বেশি প্রবল স্রোতের পানি এসেছে যা কল্পনার বাইরে। তিনি আরো বলেন, বন্যা পরবর্তী সময়ে সরকারি বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লোকজন আমাদেরকে শুকনো খাবার দিয়ে সহযোগিতা করেছে। এখন আমাদের ঘরবাড়ির পানি নেমে গেছে। তাই শুকনো খাবারের চেয়ে এখন ভারী রান্না করা খাবার প্রয়োজন। এরজন্য চালডাল ও নিত্যপণ্য দরকার। তাছাড়া আমাদেরকে স্থায়ীভাবে পুর্ণবাসনের জন্য ঘরবাড়ি নির্মাণ করা ও বাড়ির আঙ্গিনায় মাটি কাটা প্রয়োজন। তাই আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে পুর্ণবাসনের জন্য সরকারের কাছে জোড় দাবি জানাই।
সংশ্লিষ্ট পোড়াগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী জামাল উদ্দিন জানান, আমারা ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছি। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্থদের বিষয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সরকারিভাবে এখানো তেমন কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদ রানা বলেন, হঠাৎ পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থদের পুণর্বাসনের জন্য উপজেলা প্রশাসন হতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে বরাদ্দ চাহিদা প্রেরণ করা হয়েছে। পরবর্তীতে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া বন্যার্তদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরনসহ ইতোমধ্যে বিভিন্ন ত্রাণ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, এবারের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় শেরপুর জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এলাকার শতশত ঘরবাড়ি ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। একইসাথে রাস্তাঘাট বিনষ্ট হয়েছে। এছাড়াও বানের পানিতে ডুবে শুক্রবার (১১ অক্টোবর) পর্যন্ত ৮ দিনে নারী ও শিশুসহ মারা গেছেন ১২ জন।
এরা হলো- নালিতাবাড়ী উপজেলার খলিশাকুড়া গ্রামের ইদ্রিস আলী (৬৬), অভয়পুর গ্রামের দুই ভাই হাতেম আলী (৩০) ও আলমগীর হোসেন (১৬), বাঘবেড় বালুরচর গ্রামের গৃহবধূ অমিজা খাতুন (৪৫), বাতকুচি গ্রামের বৃদ্ধা জহুরা খাতুন (৭০), নালিতাবাড়ীতে নানা বাড়ি বেড়াতে আসা শেরপুরের ধলা ইউনিয়নের চান্দেরনগর কড়ইতলা গ্রামের জামানের ৮ বছর বয়সী কন্যাশিশু জিমি আক্তার, কলসপাড় ইউনিয়নের ঘোনাপাড়া এলাকার আব্দুর রশিদ (৫০), নকলা উপজেলার জালালপুর চিকনা এলাকার উজ্জল মিয়া (৫০), গণপদ্দি গজারিয়া এলাকায় আব্দুর রাজ্জাক (৬০) ও নকলা উপজেলার টালকি ইউনিয়নের বড়পাগলা গ্রামের রফিকুল ইসলামের ৫ বছর বয়সী ছেলে রহিম ও শেরপুরের তমির উদ্দিন। এছাড়াও ঝিনাইগাতিতে বন্যার পানিতে ভেসে এসেছে এক অজ্ঞাত নারীর লাশ।