নীতিগতভাবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে আপত্তি নেই মিয়ানমারের। তবে এক্ষেত্রে চারটি শর্ত আছে তাদের। শর্ত চারটি হচ্ছে- যেসব রোহিঙ্গা মিয়ানমারে দীর্ঘদিন বসবাসের প্রমাণপত্র দাখিল করতে পারবেন, স্বেচ্ছায় রাখাইনে ফিরতে চাইবেন, পরিবারের কেউ রাখাইনে রয়েছেন তেমন প্রমাণ দেখাতে পারবেন এবং বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া শিশুর বাবা-মা উভয়েই মিয়ানমারের স্থায়ী বাসিন্দা প্রমাণিত হলে তবেই তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে।
মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পার্মানেন্ট সেক্রেটারি ইউ কিইয়াও জেয়া এ শর্তের কথা জানিয়েছেন। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার এক খবরে এই তথ্য জানানো হয়েছে। ইউ কিইয়াও জেয়া’র দেওয়া শর্তগুলোকে ‘কড়া’ বলেই উল্লেখ কর হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে শুক্রবার ভারত-মিয়ানমার সম্পর্ক নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শরণার্থী বিষয়ে দেশটির এই অবস্থানের কথা তুলে ধরেন ইউ কিইয়াও জেয়া। তিনি বলেন, স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি গত ১২ অক্টোবর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। রাখাইনে পুনর্বাসন এবং উন্নয়নের কাজও শুরু হচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনার কাজ হবে চারটি শর্ত সাপেক্ষে। যারা সেই শর্ত পূরণ করতে পারবে, শুধু তাদেরই ফিরিয়ে নেওয়া হবে।
কিন্তু বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১০ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের কূটনীতিক যে শর্তগুলোর কথা বলছেন, তা পূরণ করা কঠিন বলে মনে করেন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে আসা বিদেশি কূটনীতিকরা। তারা বলছেন, বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়ার পর প্রাণ বাঁচাতে যারা ভিটেমাটি ছেড়ে এসেছেন, তাদের কাছে নিজেদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে প্রমাণের কোনো নথি না থাকাটাই স্বাভাবিক। কলকাতার ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ, ইয়াঙ্গুনের ভারতীয় দূতাবাস এবং মিয়ানমারের বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সম্মেলনেও বিষয়টি উঠে আসে। এর উত্তরে ইউ কিইয়াও জেয়া বলেন, স্কুলে পড়া, হাসপাতালে চিকিত্সা, চাকরির নথি- এসবের মতো কিছু প্রমাণ তো দেখাতেই হবে। না হলে ফেরত নেওয়াটা কঠিন। রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে কেন এতো কড়া শর্ত- তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, রাখাইন প্রদেশের এই সমস্যা কেবল মানবিক বিষয় নয়। নিরাপত্তাও একটা বড় কারণ। রাখাইনে সমস্যা সমাধানে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে এগিয়ে যাওয়াকে নিজেদের আন্তরিকতার প্রমাণ হিসেবে দেখিয়েছেন ইউ কিইয়াও জেয়া।
সম্মেলনে যোগদানকারী ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং)-এর সাবেক প্রধান রাজেন্দ্র খানাও জানান, রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে চলবে না। ২০০৪ সাল থেকে আইএসআই রাখাইনে সক্রিয়। পাকিস্তানি মদদেই মহম্মদ ইউনূস ‘রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন’ গড়ে তোলেন। পরে মুজাম্মিল এবং রাহিল নামে দুই লস্কর কমান্ডারকে আইএসআই বাংলাদেশ হয়ে রাখাইনে পাঠিয়েছিল। রোহিঙ্গা আন্দোলনকারীদের তারাই জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেয়। আইএসআই-এর মদদেই পরবর্তীতে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ বা আরসা’র জন্ম হয়। এই অঞ্চলে উগ্রপন্থা বাড়লে ভারত-মিয়ানমার উভয়েরই সমস্যা হবে বলে মনে করেন তিনি। তার সঙ্গে একমত জেয়াও। তিনি জানান, রোহিঙ্গা জঙ্গিদের যারা মূল হোতা, তাদের পরিবার কিন্তু পাকিস্তানেই বসবাস করে। সেখানে রোহিঙ্গা জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলেও সংবাদমাধ্যম বার বার খবর দিয়েছে।
যদিও প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যকার শরণার্থী সঙ্কটের বিষয়ে ভারত ইতিমধ্যে বলেছে, মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ থেকে ফেরত নিতে হবে। একই অবস্থান বিশ্ব সম্প্রদায়েরও।
এদিকে নিউ লাইট অব মিয়ানমারের এক খবরে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মংডুতে নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) বিলি শুরু করেছে মিয়ানমার সরকার। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুসরণ করে যাচাইয়ের মাধ্যমে কারা মিয়ানমারের নাগরিক, তা নিশ্চিত হয়ে এই এনভিসি দেওয়া হচ্ছে। তবে ওই আইনে মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করেনি মিয়ানমার। রোহিঙ্গারা যে রাখাইনের বাসিন্দা, ইতিহাস ঘেঁটে তার প্রমাণ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরা হলেও মিয়ানমারের দৃষ্টিতে এরা ‘অবৈধ বাঙালি অভিবাসী’।
রাখাইনে সহিংষতার কারণে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আসা শুরু ১৯৭৮ সালে। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়ে যায়। গত ২৫ অগাস্ট নতুন করে রাখাইনে সেনা নির্যাতন শুরু হলে বাংলাদেশ আশ্রয় নিয়েছে ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা।
দৈনিক ইত্তেফাক