পাহাড়ের রানী সাজেক ভ্যালি, রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন। অপার্থিব সৌন্দর্যের লীলাময় এই সাজেক সমুন্দ্রপৃষ্ট থেকে ১৪৮৮ ফুট উপরে অবস্থিত। অনেকে সাজেক ভ্যালিকে বাংলাদেশের দার্জিলিং বলেও আখ্যায়িত করেন। রাঙ্গামাটিতে এর অবস্থান হলেও এখানে যেতে হয় খাগড়াছড়ি হয়ে। যাত্রাপথের পুরো রাস্তাটাই অপূর্ব, চারপাশে মনোরম দৃশ্য। পথের দুই পাশে ছিমছাম লাল-সবুজ বাড়ি, আর পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে বসে মেঘের মেলা।
ঢাকা টু খাগড়াছড়িঃ বাসে করে ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি যেতে হবে। নন-এসি বাস ৫২০ টাকা (শ্যামলী, শান্তি পরিবহন, ঈগল, ইকোনো, এস আলম ইত্যাদি), এসি বাস ৮০০ টাকা (একমাত্র সেন্টমার্টিন পরিবহন)। ঢাকা থেকে বাস ছাড়ে সকালে ও রাতে (১১.০০ টায়) এবং খাগড়াছড়ি থেকে বাস ছাড়ে সকালে ও রাতে (৯.০০ টায়)। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি যেতে সময় লাগবে রাতে ৭/৮ ঘন্টা এবং দিনে ৮/১০ ঘন্টা।
খাগড়াছড়ি টু সাজেকঃ খাগড়াছড়ি শহড়ের শাপলা মোড় থেকে চান্দের গাড়ী/ সিএনজি রিজার্ভ করে সাজেক যাওয়া যাবে। এছাড়াও নিজস্ব মাইক্রো বা কার নিয়েও যাওয়া যাবে। সময় লাগবে সবমিলিয়ে ৩ ঘন্টা। চান্দের গাড়ী ভাড়া ৫০০০/৬০০০ টাকা (দরদাম করতে হবে), সিএনজি ভাড়া ৩০০০/৪০০০ টাকা (সিএনজিতে না যাওয়াই ভাল কারন প্রকৃতি ভালভাবে দেখা যাবে না)। যাওয়ার পথের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে হলে চান্দের গাড়ীর ছাদে বসে যেতে হবে। সেই ক্ষেত্রে সাবধানে ধরে বসতে হবে। একটি চান্দের গাড়ীতে অনায়াসে ১২ জন যেতে পারবেন।
যেভাবে সময় কাটাতে পারেন সাজেক ভ্রমণে
ঢাকা থেকে নাইট কোচে রওনা হয়ে ভোরবেলা খাগড়াছড়ি। একটু ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করেই ফোর হুইলার জিপে চেপে বসতে হবে; গন্তব্য সাজেক। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চকর যাত্রা ! বিকেলবেলা পাশের রুইলুই পাড়ায় ঘোরাঘুরি করাটাই উত্তম। রাতে ডিনার শেষে আড্ডা গল্প আর ঘুম। চাইলে বারবিকিউও করা যাবে। পরদিন খুব ভোরে পাহাড়ের চূড়া থেকে সূর্যোদয় অবলোকন। নয়নাভিরাম সাজেকের নয়নাভিরাম ভোর। ব্রেকফাস্টের পরে ৩০-৪০ মিনিট হেঁটে চলে যেতে পারেন কংলাক পাড়ায়।
কংলাক সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া। কংলাকের রাস্তা কাঁচা আর খানিকটা পাহাড়ও আছে, তাই ভালো গ্রিপ আছে এমন জুতা পায়ে দিয়ে যাবেন। কংলাকে ঘোরাঘুরি আর বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাস নেয়ার পর খানিকটা এগোলেই পাবেন কমলা বাগান। তারপর আবার খাগড়াছড়ি ফিরে আসা। আবার সেই দম বন্ধ করা সৌন্দর্যের আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ !
ফিরতি পথে বাঘাইহাট এলাকার হাজাছড়া ঝর্ণা দেখে আসতে পারেন। রাস্তা থেকে ১০-১৫ মিনিট হেঁটে ভেতরের দিকে গেলেই ঝর্ণার দেখা মিলবে।পরদিন সকালে শহরের শাপলা চত্বর থেকে জিপ রিজার্ভ নিয়ে চলে যাবেন রিসাং ঝর্ণায়। ঝর্ণা থেকে ফিরতি পথে ঘুরে আসতে পারেন প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ আলুটিলায়। সুড়ঙ্গে ঢুকার জন্যে অ্যাডভেঞ্চারের অংশ হিসেবে মশাল কিনতে পারবেন ওখান থেকেই, তবে মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট ব্যবহার করাই উত্তম। মশালের আলোতে খুব ভালো দেখা যায় না।
বিকেলটা শহরের পাশে জেলা পরিষদ পার্কে পাহাড়, ঝুলন্ত ব্রিজ আর লেকে কাটিয়ে দিবেন। সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে ব্যাগ গুঁছিয়ে একটু ফ্রেশ হয়েই ডিনার। তারপর ঢাকার বাস ধরে ফিরে আসবেন।
কোথায় থাকবেন?
সাজেকে রাতে থাকতে হলে ঢাকা থেকে থাকার জায়গা বুকিং দিয়ে যেতে হবে নতুবা থাকার জন্য ভাল যায়গা নাও পেতে পারেন। অন্তত মাস খানেক আগে বুকিং দিলে ভাল রুম পেতে পারেন। থাকার জন্য যেসব রিসোর্ট বা জায়গা আছে তা হলোঃ
১) সাজেক রিসোর্ট (রুইলুই পাড়া): যোগাযোগ ০১৭৮৩৯৬৯২০০। মোট ৪ টি রুম আছে। আর্মি অফিসারদের জন্য ভাড়া ২৫০০-৫০০০, সরকারী কর্মকর্তাদের জন্য ভাড়া ৪০০০-৭০০০, সাধারন জনগনের জন্য ভাড়া ১০০০০-১৫০০০ টাকা প্রতি রাতের জন্য।
২) রুনময় রিসোর্ট (সাজেক ভ্যালী): যোগাযোগ ০১৮৬৫৬৮৮৭৭। মোট ৫ টি রুম আছে। আর্মি অফিসারদের জন্য ভাড়া ১২৫০-১৬৫০, সরকারী কর্মকর্তাদের জন্য ভাড়া ২৫৫০-৩১৫০, সাধারন জনগনের জন্য ভাড়া ৪৪৫০-৪৯৫০ টাকা প্রতি রাতের জন্য।
৩) রুইলুই পাড়া ক্লাব হাউসঃ যোগাযোগ ০১৮৩৮৪৯৭৬১২, ০১৮৬০১০৩৪০২। ১৫ জন থাকতে পারবেন। ভাড়া ১০০ টাকা জনপ্রতি (কম-বেশী হতে পারে)।
৪) আলো রিসোর্টঃ যোগাযোগ ০১৮৬৩৬০৬৯০৬। মোট ৬ টি রুম। ভাড়া ৭০০-১০০০ টাকা প্রতি রাতের জন্য।
৫) রুইলুই পাড়াতে যে কোন কারবারীর ঘরে জনপ্রতি ১০০ টাকা দিয়ে থাকা যাবে (যদি ফাকা থাকে)।
রিসোর্টে খাবার ব্যবস্থা আছে তবে যারা দিনে গিয়ে দিনে চলে আসবেন তারা বাইরে ১৫০-৫০০ টাকা দিয়ে দুপুরের খাবার খেতে পারবেন।
কোথায় খাবেন?
উপরে উল্লেখিত রিসোর্টগুলোতে থাকলে আশেপাশের রেস্তোরাঁয় খেতে হবে। রুইলুই পাড়ায় বেশ কিছু রেস্তোরাঁ আছে। খাওয়ার প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে খাবার অর্ডার করতে হবে। অর্ডার না পেলে এরা কোনো খাবার তৈরী করে না। এছাড়া চাইলে স্থানীয় আদিবাসীদের বাড়িতেও অল্প টাকায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবেন। সাজেকের বিভিন্ন অঞ্চলে লুসাই, পাংখোয়া আর ত্রিপুরাদের বসবাস রয়েছে। যাত্রাপথের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট টং দোকানে চা-নাস্তা করার ব্যবস্থা রয়েছে।
সাজেকে বিয়ার-হুইস্কি বা এধরনের কোনো পানীয় পাওয়া যায় না। তবে আদিবাসীদের তৈরী এক ধরনের পানীয় পাওয়া যায়। ওটা খেলে প্রচন্ড মাথা ঘোরায় এবং সাজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে যায়। এই জিনিস থেকে দূরে থাকাই ভালো।
পরিশেষে দুটো অনুরোধ করছি, আদিবাসীদের ছবি তোলার আগে অনুমতি নিয়ে নিবেন। অনুমতি ছাড়া ছবি তুললে এরা খুব বিরক্ত হয়। আর হ্যাঁ, অবশ্যই যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা (পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট) ফেলে পরিবেশ নষ্ট করবেন না। মনে রাখবেন, সাজেক আমাদের সম্পদ এবং আমাদেরকেই এই সম্পদের যত্ন করতে হবে।
সম্পাদনা:-এম. সুরুজ্জামান, বার্তা সম্পাদক, শেরপুর টাইমস ডটকম।