কারও মৃত্যুর সংবাদ শোনামাত্র কর্তব্য হলো- ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়া। ইন্তেকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার হাত-পা সোজা করে দেওয়া। চোখ-মুখ বন্ধ করে দেওয়া। খাটিয়ার ওপর শুইয়ে সম্পূর্ণ শরীর চাদর দ্বারা ঢেকে দেওয়া। যত দ্রুত সম্ভব দাফনের ব্যবস্থা করা। মুসলিম : ৯১৮
মৃত ব্যক্তির হাতদ্বয় সিনার ওপর রাখা যাবে না, বরং তার দুই পাশেই রাখতে হবে। গোসল দেওয়ার আগে মৃত ব্যক্তির পাশে উচ্চৈঃস্বরে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করা মাকরুহ। মৃত্যুর খবর প্রচার করা এবং অনতিবিলম্বে কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা মুস্তাহাব। সহিহ বোখারি : ১১৬৮
মৃতকে গোসল দেওয়ার নিয়ম
মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়া ফরজে কেফায়া। কিছু লোক যদি তাকে গোসল করিয়ে দেয়, তাহলে সবার পক্ষ থেকে সে ফরজ আদায় হয়ে যাবে। যদি কেউ তাকে গোসল করিয়ে না দেয়, তাহলে সবাই গোনাহগার হবে। সহিহ বোখারি : ১১৮৬
মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়ার পদ্ধতি হলো এমন চকিতে তাকে রাখা, যার ওপর বেজোড়সংখ্যক সুগন্ধি দিয়ে ধুনি দেওয়া। তার সতর তথা পুরুষের ক্ষেত্রে নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত কাপড় দ্বারা আবৃত করবে। এরপর তার শরীর থেকে কাপড় খুলবে। নামাজের অজুর মতো তাকে অজু করাবে। তবে কুলি করাবে না এবং নাকে পানি দেবে না। বরং পানিতে কাপড় ভিজিয়ে ওই কাপড় দ্বারা মুখ মুছবে। এরপর বরইপাতার সেদ্ধ পানি তার ওপর ঢালা হবে। যদি বরইপাতা পাওয়া না যায়, তাহলে বিশুদ্ধ পানি দ্বারা গোসল দেওয়া যাবে। তার মাথা ও দাড়ি সাবান দ্বারা ধৌত করা যাবে। আবু দাউদ : ২৭৩২
এরপর তাকে বাঁ পাশ করে রেখে তার ওপর পানি ঢালতে হবে, যাতে নিচেও পানি পৌঁছে। এরপর ডান পাশ করে শুইয়ে পানি ঢালতে হবে, যাতে সেদিকে নিচে পর্যন্ত পানি পৌঁছে। এরপর তাকে ঠেক লাগিয়ে বসানো হবে। পেট বিনম্রভাবে দাবানো হবে। কোনো মলমূত্র বের হলে সেগুলো ধুয়ে দিতে হবে। আবার গোসল দিতে হবে না। এরপর কাপড় দিয়ে মুছে দেবে। সহিহ বোখারি : ১৬২
এরপর তার দাড়িতে ‘হনুত’ এবং সিজদার স্থানগুলোতে কর্পূর দেওয়া হবে। সহিহ বোখারি : ১১৮০
তবে মৃতের নখ ও চুল কাটা যাবে না। সুনানে কুবরা : ৬৮৭৬
আর মৃত ব্যক্তি নারী হলে তাকে পরিপূর্ণভাবে সতর আবৃত করে গোসল দেবে। মৃতের মাহরাম বা অন্য নারী ওই মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেবে।
মৃতের কাফন
মৃত ব্যক্তিকে কাফন দেওয়া মুসলমানদের ওপর ফরজে কেফায়া। আবু দাউদ : ২৮১৯
তাই কমপক্ষে এমন পরিমাণ কাফন পরিধান করাবে, যা দিয়ে মৃত ব্যক্তির পুরো শরীর আবৃত হবে। সহিহ বোখারি : ১১৯৮
মৃত ব্যক্তিকে তার নিজস্ব সম্পদ থেকে কাফন দেবে, যাতে অন্যের হক সংশ্লিষ্ট না থাকে। সহিহ বোখারি : ৫/১৪
যদি নিজের কোনো সম্পদ না থাকে, তাহলে তাকে কাফন দেওয়ার দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তাবে জীবিত অবস্থায় যাদের আহার-বিহারের দায়িত্ব তার ওপর ছিল। যদি তাদের কাছেও কোনো সম্পদ না থাকে, তাহলে কাফনের ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে করতে হবে। যদি রাষ্ট্রব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে সক্ষম ও সচ্ছল মুসলমানদের ওপর তার কাফনের ব্যবস্থা করা ওয়াজিব।
জানাজার নিয়ম
জানাজায় ইমাম মৃত ব্যক্তির বক্ষ বরাবর দাঁড়াবে। সহিহ বোখারি : ১২৪৬
ইমামের পেছনে মুক্তাদিদের কাতার হবে। ইবনে হিব্বান : ৩১০২
সবাই আল্লাহর ইবাদত হিসেবে জানাজার ফরজ আদায়ের নিয়ত করবে। সহিহ বোখারি : ১
উল্লেখ্য, নিয়ত মনে মনে করা ফরজ। মুখে পড়া ফরজ নয়। তাই মনে মনে শুধু এতটুকু নিয়ত করলেই হবে যে জানাজার নামাজ ফরজে কেফায়া, চার তাকবিরের সঙ্গে এই ইমামের পেছনে আদায় করছি। নামাজ আল্লাহর জন্য, দোয়া মাইয়্যেতের জন্য।
এরপর তাকবিরে তাহরিমা বলবে এবং কান পর্যন্ত হাত ওঠাবে। এরপর ছানা পড়বে। এরপর তাকবির বলে দরুদ পাঠ করবে। এই তাকবিরে হাত ওঠাবে না। তারপর তৃতীয় তাকবির বলে মৃত ব্যক্তি ও মুসলমানদের জন্য দোয়া করবে। তখনো হাত ওঠাবে না। তারপর চতুর্থ তাকবির বলবে। তখনো হাত ওঠাবে না।
অতঃপর ডান ও বাঁদিকে সালাম ফেরাবে। সুনানে কুবরা : ৭২৩৮
ইমাম তাকবির উচ্চৈঃস্বরে বলবেন এবং বাকি দোয়া-দরুদ অনুচ্চৈঃস্বরে পড়বেন। মুক্তাদিরা সবই অনুচ্চৈঃস্বরে পড়বেন। আবু দাউদ : ২৭৮৪
জানাজার সুন্নত নিয়ম
১. মৃত ব্যক্তি পুরুষ হোক বা নারী, ইমাম তার সিনা বরাবর দাঁড়াবেন। বোখারি : ১২৪৬
২. প্রথম তাকবিরের পর ছানা পড়া। জানাজার ছানা নামাজের ছানার চেয়ে একটু ভিন্ন। যেমন (উচ্চারণ), সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা, ওয়াতা বারাকাসমুকা, ওয়া তায়ালা জাদ্দুকা, ওয়া জাল্লা ছানা-উকা ওয়া লা-ইলাহা গায়রুক।
৩. দ্বিতীয় তাকবিরের পর দরুদ পড়া। (আমাদের নামাজে যেই দরুদ পড়ি) ৪। তৃতীয় তাকবিরের পর দোয়া পড়া। ইবনে আবি শায়বা : ৩/২৯৫
মৃত ব্যক্তি যদি বালেগ পুরুষ বা মহিলা হয়, তবে এই দোয়া পড়া উচ্চারণ : আল্লাহুম্মাগফির লিহাইয়্যিনা ওয়া মাইয়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়েবিনা ওয়া সগিরিনা ওয়া কাবিরিনা ওয়া জাকারিনা ওয়া উনছানা, আল্লাহুম্মা মান আহয়াইতাহু মিন্না ফাআহয়িহি আলাল ইসলাম ওয়ামান তাওয়াফফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফফাহু আলাল ইমান।
অর্থ : হে আল্লাহ, আমাদের জীবিত এবং মৃতদের, উপস্থিত এবং গায়েবদের, ছোট এবং বড়দের ও আমাদের নারী-পুরুষ সবাইকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের মধ্য থেকে যাকে জীবিত রাখবেন তাকে ইসলামের ওপরই জীবিত রাখুন। যাকে মৃত্যুদান করবেন তাকে ইমানের সঙ্গেই মৃত্যু দিন। তিরমিজি : ৯৪৫
মৃত যদি ছেলেশিশু হয়, তবে এই দোয়া পড়া
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মাজআলহু লানা ফারাতাঁও ওয়াজআলহু লানা আজরাঁও ওয়া জুখরাঁও ওয়াজআলহু লানা শা-ফিআও ওয়া মুশাফ্ফাআ।
আর মেয়েশিশু হলে এই দোয়া পড়া
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মাজআলহা লানা ফারাতঁও ওয়াজআলহা লানা আজরাঁও ওয়া জুখরাঁও ওয়াজআলহা লানা শা-ফিআতাঁও ওয়া মুশাফ্ফাআহ।
চতুর্থ তাকবিরের পর সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করবে। মনে রাখতে হবে, জানাজার প্রথম তাকবির ছাড়া পরের তাকবিরগুলোতে হাত উত্তোলন করবে না। আর নামাজিদের কাতার তিন, পাঁচ, সাত এভাবে বিজোড়ভাবে দাঁড় করাবে। সুনানে কুবরা : ৭২৩৮
বিশেষ অবস্থায় জানাজা
যদি মৃত ব্যক্তির অভিভাবক জানাজা আদায় করে ফেলে, তবে আবার জানাজা পড়া যাবে না। মাবসুত : ২/১২০
যদি জানাজা ছাড়া মৃত ব্যক্তিকে কবর দেওয়া হয়, তাহলে লাশ পচে ফেটে যাওয়ার আগে তার কবরের ওপর জানাজা পড়ে দেওয়া যাবে। মুসনাদে আহমদ : ২৫৫৪
যদি লাশ একাধিক হয়, তবে উত্তম হলো প্রত্যেকের জন্য পৃথকভাবে জানাজা পড়া। তবে সব লাশ একত্র করে একবার জানাজা পড়ে দেওয়াও জায়েজ। সুনানে কুবরা : ৭০৫২
যে শিশুসন্তান জন্ম নেওয়ার পর তার মধ্যে জীবিত থাকার আলামত পাওয়া যায় এবং পরে মৃত্যুবরণ করে তার নাম রাখা হবে এবং জানাজা পড়া হবে। কিন্তু যে শিশুর মধ্যে জীবিত থাকার কোনো আলামত দেখা যাবে না, তার জানাজা পড়া হবে না। বরং তাকে গোসল দিয়ে একটি কাপড় পেঁচিয়ে দাফন করা হবে। সহিহ বোখারি : ১২৭০
কোনো ওজর-অপারগতা ছাড়া মসজিদে জানাজা পড়া মাকরুহ। তবে অপারগতা থাকলে যে মসজিদে জামাত হয় সেখানে জানাজা পড়াতে কোনো সমস্যা নেই। ইবনে মাজাহ : ১৫০৬
আত্মহত্যাকারী ব্যক্তিকেও গোসল দেওয়া হবে এবং তার ওপর জানাজা পড়া হবে। দারাকুতনি : ১৭৮৮
যে ব্যক্তি নিজের মা-বাবাকে নিপীড়নের মাধ্যমে হত্যা করেছে, তার ওপর জানাজা পড়া হবে না। আবু দাউদ : ৪৪৫৬
মৃতদেহ বহনের নিয়ম
মৃত ব্যক্তিকে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া মুসলমানদের ওপর ফরজে কেফায়া। অনুরূপ মৃতদেহ বহন করাও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। সুরা মুরসালাত : ২৫, ২৬
উত্তম হলো মৃত ব্যক্তির খাট সবার আগে ওঠানোর ক্ষেত্রে ইখলাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) সাদ ইবনে মাআজের মৃতদেহ নিজ হাতে উঠিয়েছিলেন। মুসলিম : ১৫৭১
মৃত ব্যক্তির খাট চার ব্যক্তি কর্র্তৃক ওঠানো মুস্তাহাব। উত্তোলনকারী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য সুন্নত হলো মৃতদেহ নিয়ে ৪০ কদম হাঁটা। ইবনে মাজাহ : ১৪৬৭
মৃত ব্যক্তির খাট এমনভাবে ওঠানো মুস্তাহাব, যাতে মৃতদেহ নড়াচড়া না করে। সহিহ বোখারি : ৫০৬৭
মৃতদেহের পশ্চাতে গমন করা তার অগ্রভাগে গমন থেকে উত্তম। মৃতদেহ মাটিতে রাখার আগে বসা মাকরুহ। তিরমিজি : ৯৪১
দাফনের নিয়ম
কবর কমপক্ষে কোমর পরিমাণ গভীর হওয়া মুস্তাহাব। তার চেয়ে বেশি হলে আরও উত্তম। আবু দাউদ : ২৮০০
কবরকে ‘লাহাদ’ বানানো উত্তম। যদি মাটি নরম হয়, তবে ‘শক’ বানানো যায়। তিরমিজি : ৯৬৬
মৃত ব্যক্তিকে কবরে ডান পাশ করে কিবলামুখী রাখা। মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখার সময় ‘বিসমিল্লাহি ওয়াআলা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহ’ বলা। মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখার পর কাফনের গিরা খুলে দেওয়া।
মৃত ব্যক্তি নারী হলে তাকে কবরে রাখার সময় পর্দা দেওয়া। আর পুরুষ হলে কবরে পর্দা না দেওয়া।
মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখার পর ওপরে কাঁচা ইট বা বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে আগে কবরের মুখ বন্ধ করে দেওয়া। পাকা ইট দেওয়া মাকরুহ। যদি কাঁচা ইট বা বাঁশ ইত্যাদি পাওয়া না যায়, তবে পাকা ইট দেওয়া মাকরুহ নয়।
মৃত ব্যক্তির দাফনে শরিক সবাই নিজের উভয় হাতে কবরে তিনবার মাটি দেওয়া মুস্তাহাব। প্রথমবার মাটি ঢালার সময় বলবে ‘মিনহা খালাকনাকুম’, দ্বিতীয়বার মাটি ঢালার সময় বলবে ‘ওয়া ফিহা নুঈদুকুম’, তৃতীয়বার ঢালার সময় বলবে ‘ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা’।
এরপর মাটি দিয়ে কবরকে বন্ধ করে দেবে। মাটির স্তূপ দিয়ে কবরকে উটের পিঠের মতো বানাবে। চৌকোনা বানাবে না।
সৌন্দর্য ও গৌরব করে কবরের ওপর ঘর বানানো হারাম। কবরকে শক্ত করার জন্য বানানোও মাকরুহ।
ঘরে মৃত ব্যক্তি দাফন করা মাকরুহ। কারণ ঘরে দাফন করা নবীদের বৈশিষ্ট্য।
অপারগতার কারণে এক কবরে কয়েকজনকে দাফন করা জায়েজ আছে। এক কবরে একাধিক মৃতদেহ দাফন করার ক্ষেত্রে মুস্তাহাব হলো মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে মাটির স্তূপ বানিয়ে পৃথক করে দেওয়া।
জাহাজে কেউ মৃত্যুবরণ করলে তাকে গোসল দেওয়া হবে, কাফন পরানো হবে এবং জানাজাও পড়া হবে। যদি মাটি বেশি দূরে হয় এবং এত সময়ের মধ্যে মৃতদেহ পচে যাওয়ার আশঙ্কা হয়, তবে তা সাগরে ভাসিয়ে দেবে।
মৃত ব্যক্তি যে স্থানে মৃত্যুবরণ করেছে, সেখানেই দাফন করা মুস্তাহাব।
যদি মৃত ব্যক্তিকে কবর দেওয়ার সময় কিবলামুখী রাখা না হয় অথবা বাঁ পাশ করে শোয়ানো হয় এবং কবর বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন এসব শুদ্ধ করে দেওয়ার জন্য কবর খোঁড়া নিষেধ।