করোনারকালীন এই সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যখন কোনো মনোরম পরিবেশের দৃশ্য বা অরণ্যের ছবি দেখা হয়, তখন মনে হয় সবাই মিলে যদি সেখানে ঘুরে আসতে পারতাম, তা হলে কতোই না আনন্দ হতো! ঝরনার ছবি দেখে চেয়ে থাকা, সাগরের ছবি দেখে বুকের ভেতরটা হাহাকার হয়ে ওঠা, অরণ্যের ছবি দেখে কিছুক্ষণের জন্য হলেও হারিয়ে যেতে কার না ইচ্ছা করে? প্রকৃতির রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে আমরা প্রতিদিন স্বপ্ন দেখি, বিশেষ করে শীত মৌসুমে এই স্বপ্ন আরও গভীর হয়। সত্যিই একদিন সবকিছু রেখে ঘুরে বেড়ানোর দিন আসে, স্বপ্ন তখন বাস্তবে রূপ নেয়।
বলছি নালিতাবাড়ী উপজেলার মধুটিলার পাহাড় ও পানিহাটা-তারানি পাহাড়ের কথা। পাহাড়ের সঙ্গ পেতে সম্প্রতি আমরা ছুটে গিয়েছিলাম ভারত-বাংলার সীমান্তবর্তী শেরপুর জেলাধীন নালিতাবাড়ী উপজেলায়। গত ৬ জানুয়ারি উটঝজঅ ঝঙঋঞ এর শিক্ষার্থীরা মিলে সিদ্ধান্তের প্রতি অনুগত হয়ে আমরা সবাই ঠিক করি নালিতাবাড়ি উপজেলার গারো পাহাড় তথা মধুটিলা ইকোপার্কের প্রকৃতিতে হারিয়ে যেতে। যেই কথা, সেই কাজ। এদিনটিতে যা হয়, এর সবটুকুই আনন্দ আর আনন্দ। এই একটা দিন সবাই মিলে অনেক হাসি, গান, আড্ডা, গল্প আর অরণ্যের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া। আনন্দ ভ্রমণ বলে কথা! কনকনে শীতসহ সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে আমরা সকাল ৮টায় যাত্রা শুরু করলাম এবং পৌঁছেও গেলাম যথাসময়ে। আমাদের নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে মনে হলো আজ হয়তো আমরাই মধুটিলা ইকোপার্ক ভ্রমণের সেরা দল। শুরু হলো এদিক-সেদিক ঘুরাঘুরি, ক্যামেরাবন্দি হওয়া। আমাদের সবার পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠলো গারো পাহাড়ে ঘেরা মধুটিলা ইকোপার্ক। উচু নিচু পাহাড়ে উঠার জন্য গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই নজরে পরলো উঁচু গাছের সারি আর রাস্তার দুই পাশে রকমারি পণ্যের দোকান। তার ঠিক পরেই পাহাড়ি ঢালুর আঁকাবাঁকা রাস্তা। পাহাড়ে প্রবেশ পথেই যেন আমাদের অভ্যর্থনা জানালো দুটো বিশাল হাতি। হাতি দুটো ধূসর রঙের বিশাল আকৃতির শুঁড় উঁচানো পাথরের তৈরি। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে উপভোগ করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকলাম সামনের দিকে। দেখা মিললো সেই উচু-নিচু পাহাড়, যে পাহাড় দেখার জন্য আমাদের যাওয়া। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার সময় আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পথে দেখা যায় ঘন ঘন গাছের সারি। তারপর উচু আরেকটি পাহাড়ের একদম উপরে গিয়ে দেখি গাছের ছায়ায় বসে কাটানো যাবে দুপুর ও বিকেল। কিন্তু এখনও ওয়াচ টাওয়ারে উঠার বাকি। তাই দেরী না করে উঠে পরলাম ওয়াচ টাওয়ারে । ভারতে অবস্থিত উঁচু উঁচু পাহাড় আর সীমান্তবর্তী সবুজ গারো পাহাড় দেখে মনে হয় যদি উড়ে যেতে পারতাম! স্থানীয় লোকজন আমাদের জানিয়েছিলো মাঝে মধ্যে ওয়াচ টাওয়ার থেকেই দেখা মিলে বুনোহাতির দলের দেখা। তারা সাধারণত শেষ বিকেলে অথবা সন্ধ্যায় গভীর অরণ্য থেকে নেমে আসে।
দুপুর ১টা ১০ মিনিটে অন্য আরেকটি ছোট পাহাড়ে গিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য সবাই একত্রে গোল হয়ে বসলাম। আমরা প্রায়ই হয়তো এ রকম খাবার খাই। কিন্তু এ রকম আয়োজনের জন্য এমন মজাদার খাবার তৈরি করার মতো বাবুর্চি কমই মেলে। তা ছাড়া বিশাল এ শিক্ষাসমাজ নিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে খোলা আকাশের নিচে বসে সবাই মিলে এভাবে খাবার খাওয়া সচরাচর হয় না। খাওয়া শেষে একটু বিশ্রাম নেয়ার পালা। ঘাসের বিছানায় বসে ছোট ছোট দল হয়ে গল্প, আড্ডা, ছবি তোলা, সুরেলা আর বেসুরেলা গলায় গান এবং অযথাই হাসাহাসি যেন ঘটে যাওয়া অতীতের সব দুঃখকে ভুলিয়ে দেয়।
দুপুর ২টায় খাওয়া ও আড্ডা শেষে আবার যাত্রা শুরু হয় আবার অপরূপা পানিহাটা-তারানি পাহাড়ের দিকে। ঠিক ৩০ মিনিট পর তারানি পাহাড়ে গিয়ে পৌঁছানোর পর যা দেখতে পাই তা সত্যিই মনকে করেছে প্রফুল্ল। উত্তরে ভারতের তুরা পাহাড়কে আবছা আবরণে ঢেকে আছে মেঘ-কুয়াশা। তুরার অববাহিকা থেকে সামনে সোজা এসে পশ্চিমে চলে গেছে পাহাড়ি নদী ভোগাই। নদীর একপাশে শত ফুট উঁচুতে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজে জড়ানো পাহাড় ও নদীর টলটলে পানির নিচে নুড়ি পাথরগুলো ঝিকিমিকি করছে। আর চতুর্দিকে ছোট ছোট অসংখ্য পাহাড়ের সাড়ির ছবি তোলার এক আনন্দময়ী পরিবেশ যেন ভুলে যাওয়ার নয়। তারানি পাহাড় ঘুরাঘুরি শেষে ভ্রমণে যাওয়া সবার জন্য বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজনও ছিল মনোমুগ্ধকর। ঝুড়িতে বল নিক্ষেপ, চামচ-মার্বেল মুখ নিয়ে দৌড়, বালিশ খেলা ইত্যাদি এ যেন এক আনন্দপূর্ণ পরিবেশ মনে করিয়ে দেয় ছোটবেলার কথা।
এরই মধ্যে ক্রমেই দিন শেষ হতে থাকে। ফেরার সময় হয়ে আসায় আমাদের মনটা বেদনায় ভারাক্রান্ত থাকে। ফেরার জন্য প্রস্তুতির আগেই আমাদের এই ভ্রমণকে স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখতে সবাই মিলে আবার ফটোসেশনে অংশ নিই। পুরো দিনটি সবাই ঘুরাঘুরি, ফটোসেশন, গান, আড্ডায় মাতিয়ে রেখেছিল স্থানটি। তাই দিনটি হয়তো অনেকের কাছেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে মনে করেন ভ্রমণপিপাসু এসব প্রকৃতিপ্রেমী।
যেভাবে যাবেনঃ
মধুটিলা:
ঢাকা থেকে মধুটিলা ইকোপার্কের দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটার। ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে ময়মনসিংহ হয়ে শেরপুরে যেতে হবে। শেরপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে নালিতাবাড়ী উপজেলার নন্নী বাজার হয়ে এখানে যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে দিনে এসে দিনেই ফিরে যাওয়া যায়।
পানিহাটা-তারানি পাহাড়:
ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে ময়মনসিংহ হয়ে শেরপুর শহর থেকে নালিতাবাড়ী হয়ে যাওয়া যায়। এই স্থানটি উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নে অবস্থিত। আপনি চাইলে ঢাকা থেকে শেরপুর জেলা শহরে না এসে নকলা উপজেলা শহর থেকে উত্তর দিকে অবস্থিত নালিতাবাড়ী হয়েও এখানে যেতে পারেন। তবে এটি সহজ ও কম দূরত্বের রাস্তা।
মো. সুখন,
আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয়।