সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা আপাতত নতুন কোনো কর্মসূচি দিচ্ছেন না। ছাত্রলীগের একের পর এক হামলা ও কোটা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কয়েক নেতার গ্রেপ্তারের ঘটনায় নতুন কর্মসূচি দেওয়া থেকে সরে এসেছেন তাঁরা। তাঁদের ভাষ্য, গুম ও গ্রেপ্তার-আতঙ্কে রয়েছেন তাঁরা। নতুন কর্মসূচি নয়, গ্রেপ্তার নেতাদের ছাড়িয়ে আনা এখন তাঁদের লক্ষ্য।
সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে কোটা নিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া হচ্ছে।
পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা গুম-আতঙ্কে রয়েছি। আমরা নিশ্চিত, খুঁজে খুঁজে এখন আমাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। সামনে থেকে আমরা যাঁরা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছি, তাঁদের ভবিষ্যৎ শেষ।’
হাসান আল মামুন জানান, পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক, জসীম ও মশিউরকে গতকাল মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাহফুজ নামের আরেকজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক অসুস্থ শরীরে আত্মগোপনে আছেন।
হাসান আল মামুন বলেন, ‘আমরা এখন নতুন কোনো কর্মসূচি দিচ্ছি না। যাঁরা আটক আছেন, তাঁদের ছাড়ানোর চেষ্টা করছি।’
হাসান আল মামুন অভিযোগ করে বলেন, ‘সরকার আমাদের আন্দোলন ঠেকাতে আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে। আমি কারও সঙ্গে ফেসবুকে যোগাযোগ করতে পারছি না।’
গতকালও ঢাকার বাইরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গ্রেপ্তার ছাত্রদের মুক্তি, হামলাকারীদের বিচার ও কোটাপ্রথার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছিল ছাত্রলীগের দখলে। সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা গুম, হামলা-মামলার আতঙ্কে ক্যাম্পাসে ফিরতে পারেননি। গতকাল গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা দুজনকে। এ নিয়ে চার মামলায় মোট আটজন গ্রেপ্তার হলেন। এখন পর্যন্ত নিখোঁজ আছেন একজন।
গত সোমবার মারধর করে ফারুক হোসেন নামের যে শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগের কর্মীরা শাহবাগ থানায় সোপর্দ করেন, তাঁকে গতকাল গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গতকাল বিকেলে ফারুক হোসেন ছাড়াও জসীমউদ্দীন ও তরিকুল ইসলামকে ভিসির বাড়িতে হামলা ও পুলিশের বিশেষ শাখার একজন সদস্যের মোটরসাইকেল ভাঙচুরের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আদালতে উপস্থাপনের পর বিচারক তাঁদের কারাগারে পাঠিয়ে দেন।
এর আগে গত রোববার সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তিনি পুলিশ রিমান্ডে আছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপকমিশনার মাসুদুর রহমান গতকাল আটজনের গ্রেপ্তারের খবর নিশ্চিত করেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গত শনি থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মোট চারটি মামলায় আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে তাৎক্ষণিক তিনি নামগুলো জানাতে পারেননি।
কোটা সংস্কারের দাবিতে ‘হয়রানির শিকার’ আন্দোলনকারীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন একদল আইনজীবী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের মধ্যে যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, যাঁরা গ্রেপ্তার ও হয়রানির আতঙ্কে আছেন, তাঁরা চাইলে তাঁদের আইনি সহায়তা দেওয়া হবে। ২০ জন আইনজীবী নিজ খরচে এই আইনি সহায়তা দেবেন। আন্দোলনকারীদের মধ্যে হয়রানির শিকার শিক্ষার্থীর পরিবারের সদস্যরা যোগাযোগ করলে সে ক্ষেত্রেও আইনি সহায়তা দেওয়া হবে।’
চলমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি পর্যালোচনা, সংস্কার বা বাতিলে সোমবার রাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার। এই কমিটির প্রথম বৈঠক ৮ জুলাই অনুষ্ঠিত হতে পারে।
ফাহমিদুল হক লাঞ্ছিত হওয়ার প্রতিবাদে মানববন্ধন
গতকাল কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে জানাতে গিয়ে পুলিশের হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হকের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এর প্রতিবাদে আজ বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন হয়েছে।
মানববন্ধনে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, অধ্যাপক ফাহমিদুল হক, অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানযীম উদ্দিন খান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা উপস্থিত ছিলেন।
মানববন্ধনে অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, প্রত্যেক নাগরিকের উদ্বেগ প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে। তিনি বলেন, ‘উদ্বেগ প্রকাশ করতে গেলে তাঁদের নির্যাতন করা হয়েছে। তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, লাঞ্ছিত করা হয়েছে। অত্যাচার-নির্যাতনের তদন্ত চাই, বিচার চাই।’
অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী বলেন, ‘এ ঘটনাগুলো দেখে আমি কয়েক দিন ধরে মানসিকভাবে অসুস্থ বোধ করছি। এটা কেমন বিশ্ববিদ্যালয়, এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমরা গর্ব করি। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পিটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিনা অপরাধে রিমান্ডে নিয়ে যাচ্ছে। এগুলোর বিচার দাবি করছি।’
সূত্র: প্রথম আলো