গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া পশ্চিমখন্ড গ্রামের বেলায়েত শেখ। পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে খুব অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল তাকে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার স্বপ্ন থাকলেও পূরণ করতে পারেননি। ভেবেছিলেন সন্তানরা তার সেই স্বপ্ন পূরণ করবেন। কিন্তু তিন সন্তানের কেউই তা করতে পারেননি। তাই সিদ্ধান্ত নেন নিজেই সেই অপূর্ণতার আক্ষেপ ঘোচাবেন।
সেই উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণে তিনি ২০১৯ সালে রাজধানীর বাসাবোর দারুল ইসলাম আলিম মাদরাসা থেকে দাখিল (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এরপর চলতি বছর তিনি এইচএসসি (ভোকেশনাল) পাস করেন ঢাকা মহানগর কারিগরি কলেজ থেকে। ৫৫ বছর বয়সী বেলায়েত শেখ আগামী ১১ জুন অনুষ্ঠিতব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে যাচ্ছেন।
বেলায়েত পেশায় একজন সাংবাদিক। তিনি দৈনিক করতোয়া পত্রিকার শ্রীপুর প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত আছেন। এছাড়া অনলাইন টেলিভিশন জেটিভির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। বেলায়েতের স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনার। সেই লক্ষ পূরণে সাইফুরস্ ভার্সিটি কোচিংয়ের মাওনা শাখায় ক্লাস করছেন তিনি।
বেলায়েত জানান, ১৯৬৮ সালে তার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই খুব কাছ থেকে অভাব দেখেছেন। এর মধ্যেই পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। অভাবের তাড়নায় ১৯৮৩ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি তার।
তিনি বলেন, ১৯৮৩ সালে আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। তখন বাবার অসুস্থতা এবং অভাবের তাড়নায় পরীক্ষা দিতে পারিনি। ফরম ফিলাপের টাকা দিয়ে বাবার চিকিৎসা করাতে হয়েছিল। এরপর ১৯৮৮ সালে পরীক্ষা দিতে চাইলাম। সেবছর শুরু হলো বন্যা। ১৯৯০ সালেও পরীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি। সেসময় মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। মায়ের কথা ভেবে বিয়ে করি। বাবার তখনো অভাব ছিল। সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছিল। ২৫-২৬ বছর একাধারে আমিই সংসার চালিয়েছি। এসএসসি দিতে না পারায় মেকানিক্যাল কোর্স করেছিলাম। মোটরগাড়ির ওয়ার্কশপ ছিল। সেই ওয়ার্কশপ চালিয়ে সংসার চালাতে হয়েছে। ভাই-বোনদের পড়াশোনা করানোর দায়িত্ব ছিল আমার ঘাড়ে। কিন্তু তারপরও তাদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত না করতে পারার আক্ষেপ রয়ে গেছে। এই সময়ে আর নিজের লেখাপড়ারও সুযোগ পাইনি।
বেলায়েত শেখের তিন সন্তান। ১৯৯৪ সালে তার প্রথম ছেলের জন্ম। বিরতি দিয়ে তিনি এখন গাজীপুরের একটি কলেজে অনার্সে পড়ছেন। মাওনা চৌরাস্তায় তাকে স্যানিটারির দোকান করে দিয়েছেন। সম্প্রতি তাকে বিয়েও করিয়েছেন। একমাত্র মেয়ের জন্ম ১৯৯৯ সালে। ইচ্ছে ছিল তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন। সেজন্য রাজধানীর নামকরা কলেজে ভর্তিও করিয়েছেন। কিন্তু মেয়ে সেখানে পড়াশোনা না করেই গ্রামে চলে আসেন। সেখানে এইচএসসি শেষে একটি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হন। তিনি অনার্স দ্বিতীয়বর্ষ পর্যন্ত পড়েছেন। এরপর তার বিয়ে দেন। বেলায়েতের ছোট ছেলের জন্ম ২০০৫ সালে। তিনি এবছর বেলায়েত শেখের সঙ্গে এইচএসসি পাস করেছেন।
বেলায়েত শেখ বলেন, আমার স্বপ্ন ছিল সন্তানরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। অনেক আশা ছিল তাদের নিয়ে। কিন্তু তিন সন্তানের কেউই তা পূরণ করতে পারেনি। সেই ক্ষোভ থেকে ২০১৯ সালে এসএসসি আর ২০২১ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিই শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আশায়।
তিনি বলেন, ভর্তি পরীক্ষার জন্য শুরুর দিকে প্রস্তুতি নিইনি। তবে এইচএসসি পরীক্ষার ফল ভালো হওয়ায় বাড়তি ভালো লাগা কাজ করলো। ভাবলাম, আমি চাইলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবো। আমার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরাও আমাকে পড়ালেখার সুযোগ দিচ্ছে। এরপর শ্রীপুরের মাওনায় ঢাকা থেকে পরিচালিত একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছি। আমার তো বাবা নেই, মারও বয়স হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে অভিভাবক হিসেবে কাউকে যাওয়া লাগতে পারে। এসব চিন্তা করে বড় ছেলেকে অভিভাবক দিয়েছি।
বেলায়েত আরও বলেন, বয়স চল্লিশ পার হলে পড়া আর মাথায় ঢোকে না। আমি পড়তে গেলে পড়া সহজে মুখস্থ হয় না, কষ্ট হয়। এজন্য পড়াগুলো আমি বারবার লিখি। লিখতে লিখতে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করি। বাকিটা আল্লাহর দান আর মানুষের দোয়া। সময় তো কারও জন্য অপেক্ষা করে না। আমার চুল পেকে গেছে। সেজন্য চুলে কালি দিই। বয়স বেশি হলেও নিজেকে মনের দিক থেকে তরুণ ভাবতে পছন্দ করি। ৫৫ বছর বয়সে আগামী ১১ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেবো। আল্লাহর কাছে সাহায্য ও সবার কাছে দোয়া চাই।