কাশ্মীরকে অন্ধকারে রেখে উপত্যকাটির বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা বিলুপ্ত করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার যে আগুন জ্বেলেছে তার আঁচ গতকাল মঙ্গলবার লোকসভায় বেশ তীব্রভাবেই অনুভূত হয়। তবে ভূস্বর্গ বলে পরিচিত হিমালয়কোলের এই উপত্যকার মর্যাদা রাজ্য থেকে নামিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার পর কাশ্মীরিদের প্রতিক্রিয়া কী তা জানা যায়নি। কারণ জম্মু ও কাশ্মীরের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে ভারত সরকার। গত রবিবার বিকেলে বন্ধ হয়ে যাওয়া ইন্টারনেট, টেলিফোনসহ সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা গতকালও চালু করা হয়নি। কবে হতে পারে সে সম্পর্কে কোনো ইঙ্গিতও পাওয়া যায়নি। তবে ভারত সরকার জানিয়েছে, উপত্যকা ‘শান্ত ও স্বাভাবিক’ রয়েছে। সম্প্রতি মোতায়েন ভারতের লক্ষাধিক সেনা উপত্যকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে বলে জানিয়েছে তারা।
কাশ্মীরের প্রতিক্রিয়া জানা না গেলেও গতকাল তীব্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে ভারতে বিরোধী দলগুলোর কাছ থেকে। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সদ্য বিদায় নেওয়া সভাপতি রাহুল গান্ধী বিষয়টিকে দেখছেন ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ হিসেবে, যা তাঁর দৃষ্টিতে দেশের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সোমবার মন্তব্য না করলেও গতকাল কাশ্মীরের বন্দি রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে যে প্রক্রিয়ায় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে কাশ্মীরকে কেন্দ্রের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো তাতেও তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি।
প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দেরও। স্বার্থের কারণেই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সরব পাকিস্তান। গতকাল প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেন, এই সিদ্ধান্তের পর পুলওয়ামা ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলায় ভারতের আধাসামরিক বাহিনীর ৪০ সেনা নিহত হয়। কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশন বসে গতকাল। বৈঠক করেন সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও। সব রকম পরিস্থিতির জন্য তাঁরা প্রস্তুত বলে বৈঠক থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রথম দিন নীরব থেকে গতকাল ‘পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা’র কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ভারতকে সতর্ক করে জানিয়েছে, এ সিদ্ধান্তের কারণে সহিংসতা আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলো। তারা বন্দি নেতাদের ব্যাপারেও উদ্বেগ প্রকাশ করে।
সেনা মোতায়েন, পর্যটক-তীর্থযাত্রীদের উপত্যকা থেকে বের করে দিয়ে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ টানা ১১ দিনের নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পর সোমবার কাশ্মীরকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা নিশ্চিত করে দেওয়া সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার। জম্মু ও কাশ্মীর থেকে লাদাখকে কেটে বের করে নেওয়া হয়েছে। এবার থেকে দুটি অংশের পরিচয় হবে নিছকই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে। লাদাখের বিধানসভা থাকবে না, জম্মু-কাশ্মীরের থাকবে। দুই অংশেরই ভার থাকবে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের হাতে। এই নির্বাচনী অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি পালনের মধ্য দিয়ে বিজেপির হাত দিয়ে শুরু হলো জম্মু-কাশ্মীরের এক নতুন অধ্যায়, যা ভবিষ্যতে কী রকম বাঁক নেবে, সেই ধারণা এখনো কারো নেই।
এমন এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যেই গতকাল ‘কাশ্মীর রিঅর্গানাইজেশন বিল’ ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় পাস হয়। সোমবার প্রেসিডেন্ট স্বাক্ষরিত নির্দেশটি উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পাস হয়েছে। গতকাল লোকসভায় তোলার সময় মোদির ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘ভারতের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আরেকবার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবে এই পার্লামেন্ট।’ এ সময় তিনি আরো বলেন, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর এবং চীনে আকসাই চীন নামে যে স্থানগুলো রয়েছে সেগুলোও কাশ্মীরেরই অংশ এবং এগুলোর দখল নিতে প্রয়োজনে জীবন দিতেও তিনি প্রস্তুত।
তবে অমিত শাহর ভাষায় ‘স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা’ এই দিনটি নিশ্চিত করতে কাশ্মীরের প্রথম সারির বহু নেতাকে আটক করা হয়েছে। আটক নেতাদের মধ্যে রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ও ওমর আবদুল্লাহসহ আঞ্চলিক দলের জ্যেষ্ঠ নেতা সাজেদ লোনের বিরুদ্ধে গতকাল কাশ্মীরের একটি আদালত ‘উপত্যকার শান্তি ভঙ্গের চেষ্টার আশঙ্কা’ এবং ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি’ নষ্টের চেষ্টা করতে পারেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। তাঁদের প্রাথমিকভাবে গৃহবন্দি করা হলেও পরে একটি সরকারি অতিথিশালায় নিয়ে গিয়ে রাখা হয়। ওমর আবদুল্লাহর বাবা সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহর অবস্থান নিয়েও গতকাল লোকসভায় প্রশ্ন ওঠে। এ সময় অমিত শাহ বলেন, তিনি কাশ্মীরেই আছেন। মুক্ত। তবে এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফারুক আবদুল্লাহ দাবি করেন তিনিও গৃহবন্দি।
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল উপত্যকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বর্তমানে সেখানে অবস্থান করছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনে তিনি বলেন, ভূস্বর্গ বলে পরিচিত কাশ্মীর ‘শান্ত ও স্বাভাবিক’ রয়েছে। কোনো ধরনের ‘অস্থিরতা’র কোনো চিহ্ন নেই।
যদিও অঞ্চলটির মোবাইল, টেলিফোন ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ। কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের বিবিসি সংবাদদাতা আমির পীরজাদা সোমবার দিল্লির প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম হন। তিনি বলেন, ‘রাজ্যের অন্যান্য অংশে কী হচ্ছে তা কেউ জানে না। আমরা কারো সঙ্গে কথাও বলতে পারছি না। মানুষ ভীষণ চিন্তিত, তারাও জানে না আসলে এখন কী হচ্ছে এবং কী হতে যাচ্ছে।’ ভারতের অন্যান্য স্থানে থাকা কাশ্মীরিরা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। দিল্লিতে থাকা এক ছাত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাকে জানিয়েছে, সে স্থানীয় পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। অনেক কাশ্মীরি মনে করে, সংবিধানের যে ৩৭০ অনুচ্ছেদ কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দিত, সেটিই ছিল রাজ্যটির ভারতের অংশ থাকার পেছনে প্রধান যুক্তি। আর ওই অনুচ্ছেদ বিলোপের মাধ্যমে দিল্লির সঙ্গে কাশ্মীর অঞ্চলের সম্পর্কের যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপরিবর্তনীয়।
অনুচ্ছেদ ৩৭০ কাশ্মীর রাজ্যকে বিশেষ ধরনের স্বায়ত্তশাসন ভোগ করার সুযোগ দিত, যার ফলে তারা নিজস্ব সংবিধান, আলাদা পতাকা এবং আইন প্রণয়নের অধিকার রাখত, যদিও পররাষ্ট্রবিষয়ক সিদ্ধান্ত, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগব্যবস্থা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে।
কাশ্মীরের প্রতিক্রিয়া জানা না গেলেও ভারতের অন্য রাজনীতিকরা তাঁদের অসন্তোষ দেখাতে শুরু করেছেন। প্রথম দিন নীরব থাকার পর গতকাল টুইট করে প্রতিক্রিয়া জানান রাহুল গান্ধী। টুইটে রাহুল লেখেন, ‘সংবিধানকে লঙ্ঘন করে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আটক করে এবং জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখণ্ডিত করে জাতীয় সংহতিকে শক্তিশালী করা যায় না। শুধুই কিছু জমির খণ্ড দেশটাকে গড়ে তোলেনি, দেশ তৈরি হয় জনগণকে নিয়ে। প্রশাসনিক ক্ষমতার এই অপব্যবহার দেশের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক।’
তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন একটু ভিন্নভাবে। তিনি কাশ্মীর পরিস্থিতি নয়, বরং ওখানকার রাজনীতিবিদদের নিয়ে চিন্তিত। তিনি বলেন, ‘ওঁরা কেউ জঙ্গি নন, গণতন্ত্রের স্বার্থেই ওঁদের মুক্তি দেওয়া উচিত।’ গতকাল চেন্নাই যাওয়ার পথে বিমানবন্দরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘গতকাল (সোমবার) থেকে যা ঘটছে, ভারতের বাকি নাগরিকদের মতো আমিও নজর রাখছিলাম। আমি বিশ্বাস করি, কাশ্মীরের বাসিন্দারাও আমাদের ভাই-বোন। আমি এই সিদ্ধান্তের বিষয়বস্তুর কথা বলছি না। কিন্তু পদ্ধতির সঙ্গে আমি একমত নই। আমাদের দল কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা এই বিলকে সমর্থন করতে পারি না। আমরা ভোট দিইনি। কারণ সাংবিধানিক, আইনগত ও পদ্ধতিগতভাবে এটা প্রশংসনীয় নয়। এটা গণতান্ত্রিকভাবেও করা হয়নি।’
এদিকে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের প্রতিবাদে গতকাল পাকিস্তানজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছে। গতকাল পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেন, ‘ভারতের এই সিদ্ধান্ত আরো একটি পুলওয়ামার জন্ম দেবে।’ ইমরানের দাবি, পূর্বসূরিদের ধারা মেনেই বিজেপি মুসলমানকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবেই গণ্য করতে চায়।
এ ছাড়া দেশটির আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আসিফ গফুর জানান, রাওয়ালপিন্ডিতে গতকাল সশস্ত্র বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে ভারতের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তান সরকার যে অবস্থান নিয়েছে তার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে। কাশ্মীরিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, ‘এই দায়বদ্ধতা পূরণে যেকোনো কিছু করার প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে।’
প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র মর্গ্যান অট্রাগাস বলেন, ‘দুই দেশকেই বলেছি নিয়ন্ত্রণরেখায় যেন শান্তি বজায় রাখে তারা।’ তিনি আরো বলেন, ‘জম্মু-কাশ্মীরে আটকের ঘটনা ঘটছে, এমন রিপোর্টও আসছে। বিষয়টা নিয়ে উদ্বিগ্ন আমরা।’ কোনোভাবেই যাতে সেখানে ব্যক্তি অধিকার খর্ব না হয়, সেদিকেও নজর রাখতে বলা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন অট্রাগাস।
অন্যদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও ভারত-পাকিস্তানকে সংযত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। কাশ্মীর ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্য গতকাল ওআইসির বৈঠকে বসার কথা ছিল। সূত্র: বিবিসি, এএফপি, পিটিআই, এনডিটিভি ও কালের কণ্ঠ।