হাতে-পায়ে বেড়ি বাঁধা, জিনহীন শীর্ণ উটের পিঠে রাসূল (সা.)-এর আহলে বায়েতের নারী ও এতিম শিশুদের বন্দি করে কুফায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারবালার প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের একজন হজরত মুসলিমের বর্ণনা-
কুফার গভর্নরের প্রাসাদের দরজায় পালিশ করার সময় উৎসবের শব্দ শুনছিলাম। আমি প্রাসাদের একজন ভৃত্যের কাছে প্রশ্ন করলাম, কুফা আজ এত উৎসবমুখর কেন? ভৃত্য জবাব দিল, ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীদের মাথা শহরে প্রবেশ করছে। আমি প্রশ্ন করলাম, এ বিদ্রোহী কে? ভৃত্য জবাব দিল, ‘সে হল হোসাইন ইবনে আলী’।
এ উত্তর আমাকে বিদ্যুতের মতো ধাক্কা মারলো। আমি এত জোরে আমার মুখে আঘাত করতে লাগলাম যে, চোখে ব্যথা পেলাম। আমি কাজ ফেলে দৌড়ে প্রধান সড়কে পৌঁছলাম। লোকের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম চল্লিশটি উট নারী ও শিশুদের বহন করে নিয়ে আসছে। আমি আলী ইবনে হোসাইনকে দেখলাম। একটি জিনহীন উটের পিঠে; শিকলের বাঁধনে তার গলার দুই পাশে রক্ত ঝরছে। হাত বাঁধা। তিনি কাঁদছেন আর বলছেন, হে পথভ্রষ্ট জাতি। লানত তোমাদের ওপর। আমাদের পিতামহের উম্মত হয়ে তোমরা আমাদের দিকে দৃষ্টি দাওনি। শেষ বিচারের দিন যখন আল্লাহ আমাদের রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে একত্র করবেন তখন তোমরা কী বলবে? যেন আমরা তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে শিক্ষা দিইনি; আজ তোমরা আমাদের জোর করে গদি ছাড়া উটের পিঠে করে টেনে নিয়ে যাচ্ছ। (মুহাম্মদ বাকির আল-মজলিশি, বিহার উল আনওয়ার, খণ্ড-৪৫, পৃষ্ঠা-১১৪ থেকে।) এ ভয়ংকর অবস্থা দেখে কুফার নারীরা আর্তনাদ করতে লাগল। তাদের মধ্যে একজন বন্দি কাফেলার কাছে এসে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা কার বংশধর’?
তাকে বলা হল, ‘আমরা নবী (সা.)-এর আহলে বায়েত’।
হজরত জয়নাবের প্রথম খুতবা : ইমাম হোসাইনকে হত্যা করে ইসলামী উম্মাহর প্রতি উমাইয়্যা বাহিনী চাপিয়ে দেয়া দুর্ভাগ্য ও এ অপরাধের সঙ্গে কুফাবাসীকে জড়িত করার বিষয় তুলে ধরে, জনতার চেতনায় ঐক্য আনার উদ্দেশে হজরত জয়নাব কাফেলার চারপাশে কুফার সড়কে জনতার উপচে পড়া ভিড়ের সামনে বক্তব্য দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ এরা ইমাম হোসাইনের সমর্থন ও প্রতিরক্ষার ওয়াদা করেও ভঙ্গ করেছিল। তা ছাড়া এরাই এ ধ্বংসযজ্ঞে ইমামের জন্য আহাজারির এবং বন্দি নারী-শিশুদের ক্রন্দনের কারণ।
হজরত জয়নাব সবাইকে চুপ করতে বললেন, এরপর স্থির ও সাহসিকতার সঙ্গে বলতে লাগলেন, সব প্রশংসা আল্লাহর। খোদার রহমত আমার নানা রাসূল (সা.) এবং তার পবিত্র ও ন্যায়পরায়ণ আহলে বায়েতের প্রতি। হে কুফাবাসী! হে প্রতারক ও বিশ্বাসঘাতক জনতা! তোমরা কাঁদছ? তোমাদের এ অশ্রুপাত কখনও ক্ষান্ত না হোক এবং অনুতাপের এ অবস্থা কখনও থেমে না যাক। তোমাদের তুলনা সেই নারীর মতো, যে তার বাঁধন খুলে ফেলেছে, শক্ত করে বাঁধাই করার পর তা ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে, যে সে বিষয়ে অহংকার করে না যা তার কাছে নেই, ভোগ-লালসা পরিত্যাগকারী, অহংকারী, মিথ্যাবাদী, কোনো যাচাই ছাড়াই অমান্য করে; ক্রীতদাসের মতো অনুগত; শত্রুর সামনে নিস্তেজ, ধ্বংস হওয়া ঘাসের মতো অথবা কবরের ফেলনা পোশাকের টুকরার মতো? সত্যি, তোমাদের অন্তর যা সম্পন্ন করেছে তা মন্দ। তোমরা আল্লাহর ক্রোধের সীমা অতিক্রম করে অনন্তকালের শাস্তি অর্জন করেছ।
তোমরা কি সত্যিই কাঁদছ? আল্লাহর কসম, এরপর তোমরা আরও বেশি কাঁদবে এবং সামান্যই হাসবে, আর বিনিময়ে পাবে লজ্জা ও কুখ্যাতি, আর কখনও তোমরা তা মুছে ফেলতে পারবে না। তোমরা কীভাবে তা পারবে? শেষ কিতাবের বাহকের উত্তরাধিকার, ওহির মূল, জান্নাতের যুবকদের নেতা, ন্যায়ের সংগ্রামে তোমাদের আশ্রয়, তোমাদের দুর্দশা থেকে মুক্ত করতে চাওয়া একজন, তোমাদের পথপ্রদর্শক এবং তোমাদের ঐতিহ্যের ধারককে হত্যা করা হয়েছে। আহ! কত ভয়ংকর দৃশ্য তোমরা সহ্য করেছ। তোমরা দূর হও এবং ধ্বংস হও। প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, আয়াত উপস্থিত হয়েছে, চুক্তি হারিয়ে গেছে, অথচ তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.) থেকে ক্রোধ ছাড়া আর কিছুই অর্জন করনি। তোমরা দাসত্ব ও অবমাননায় ধ্বংস হয়ে গেছ।
শোক তোমাদের প্রতি, হে কুফাবাসী! তোমরা কি জানো, তোমরা কার অন্তর পুড়িয়েছ, কী কৃতিত্বকে হারিয়েছ, কার রক্ত ও মর্যাদাকে তোমরা ক্ষুণ্ণ করেছ? তোমরা একটি পৈশাচিক কাজ করেছ যার ফলে দুনিয়া ও জান্নাত ভেঙে খান খান হয়ে গেছে, পাহাড় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। তোমরা এমন এক অস্বাভাবিক, বিকৃত, অন্ধকারাচ্ছন্ন ও ভয়ংকরতম কাজ করেছ যা জমিন ও আসমান মলিন করে দিয়েছে। তোমরা ভাবতে পার, কেন আকাশে রক্তবৃষ্টি হচ্ছে? নিশ্চয়ই পরকালের নিদারুণ যন্ত্রণা অত্যন্ত ভয়ংকর এবং তোমাদের কোনো সাহায্যকারী থাকবে না…।
পরিবেশ তার ফুফুর বক্তব্য সহ্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে দেখে, ইমাম জয়নুল আবেদিন হজরত জয়নাবকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এতটুকু যথেষ্ট, ফুফু। আল্লাহর শুকরিয়া, আপনি এমন এক জ্ঞানী যাকে কেউ শিক্ষা দেয়নি আর কোনো কিছু সম্পন্ন করা ছাড়াই আপনি অনেক কিছু উপলব্ধি করতে পারেন।
[ইবনে তাউসের কারবালার ইতিহাস গ্রন্থ থেকে নেয়া]