‘১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর। গাইবান্ধা জেলার তৎকালীন ট্রেজারিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি ক্যাম্পে ছদ্মবেশে কলা বিক্রি করতে যাই। কলা বিক্রেতা সেজে কলার ভেতর বিষ মিশিয়ে ২৮ জন পাকিস্তানি আর্মিকে হত্যা করি।’
এক সাক্ষাৎকারে একাত্তরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এমনটাই জানান স্বাধীন স্বদেশভূমির জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের দুর্নিবার বাসনা, যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্ব, একক সাহস, উদ্যম আর একাগ্রতার নায়ক জহুরুল হক মুন্সি।
একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়া এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, সেদিন ক্যাম্পে ৩০ জন পাকিস্তানি আর্মির জন্য কলা নিয়ে গেলেও দুইজন কলা না খাওয়ায় তারা বেঁচে যায়। আমি জানতাম, ক্যাম্পে কলা নিয়ে গেলে আগে আমাকে খেতে দেবে। তাই কয়েকটা কলা চুন দিয়ে চিহ্নিত করে নিয়ে যাই। তাদেরকে কলা খেতে দিলে আগে আমাকে খেতে বলল আর্মিরা। আমি চুন চিহ্নিত বিষমুক্ত কলাগুলোই খেলাম। পরে দুইজন ছাড়া বাকি সব আর্মি সদস্য কলা খায়। ওই দুইজন রোজা থাকায় কলা খায়নি। খাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়লে আশপাশে কোনো হাসপাতাল না থাকায় ২৮ আর্মি সেখানেই মারা যায়। আর গাইবান্ধার লোকজন আমাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। আমরা ঘাটে গেলে মাঝিরা নৌকা পানির নিচ থেকে ভাসিয়ে দিতো আবার পাকিস্তানিরা আসলে নৌকা পানিতে ডুবিয়ে রাখতো।
অর্ধশত বছর আগের অগ্নিঝরা সময়ের স্মৃতিচারণ করতে করতে ‘ষাটোর্ধ্ব’ বয়সী সাহসী মানুষটি মুহূর্তেই যেন নতুন করে ফিরে যান নয় মাসের সেই গেরিলা জীবনে। জানালেন যুদ্ধের সময় আক্রমণের কৌশল। ‘বহুরূপী যোদ্ধা’ হিসেবে তিনি ত্রাস সৃষ্টি করেছেন ‘চিহ্নিত’ সব শত্রু শিবিরে।
ধানুয়া-কামালপুর বিজয়ে জামালপুর-শেরপুর জেলায় তার নাম শুনেননি এমন কেউ নেই। একাত্তরে টগবগে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সি জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার বাট্টাজোড় গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান। তিনি বর্তমানে শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার পৌর শহরের পশ্চিম বাজার খামারিয়া পাড়া মহল্লায় বাস করেন। ব্যক্তিজীবনে তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক তিনি।
যুদ্ধে বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরুপ সরকার কাউকে একই পদক দুইবার দিলে তার নামের শেষে ‘বীরত্ব’ উপাধি লেখার পর প্রথম ব্রাকেটে ‘বার’ লেখার নিয়ম স্বীকৃত। ১৯৭১ এ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে― আমাদের এ মাটির সন্তান ‘জহুরুল হক মুন্সী’ই একমাত্র এই বিরল উপাধি পাওয়া বীরপুত্র! বাংলাদেশ সরকারের গেজেট নোটিফিকেশন নম্বর ৮/২৫/ডি-১/৭২-১৩৭৮। ক্রমিক নম্বর ৩৯১ এবং ৪০০। মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সি’র ভূমিকার কথা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এতে লাখো বাঙালির রক্তে মুক্ত হয় জামালপুর। উত্তোলিত হয় সবুজের বুকে লাল পতাকা। মুক্ত হয় হাজার হাজার বন্দি জনতা। শ্লোগানে মুখরিত হয় শহরের আঙ্গিনা। জামালপুর পাক বাহিনীর দূর্গে আঘাত হানার পেছনে অসীম সাহসী বীরের মধ্যে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন জহুরুল হক মুন্সি। ওই যুদ্ধে যারা বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন তাদের একজন হলেন তিনি।