খাদ্য শস্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত জেলা হিসেবে পরিচিত শেরপুর। এই করোনা পরিস্থিতিতেও ঝুঁকি নিয়েই কৃষকরা ফসল উৎপাদন অব্যাহত রাখতে মাঠে নেমেছেন। জেলার দুই লাখ ৮১ হাজার ৭৯০টি কৃষক পরিবার এখন দিনব্যাপী মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। আর অধিক ফসল উৎপাদনের কলা কৌশল জানাতে কৃষকদের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন কৃষি বিভাগের ২১৯ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তারা পরামর্শ দিচ্ছেন করোনা ভাইরাস বিষয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনতার সাথে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আবাদি জমির পাশাপাশি অনাবাদী জমিতে ফসল ফলানোর পদ্ধতি। এছাড়া চলতি বোরো ধান সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে। এছাড়া খরিপ-১ মৌসুমের আউশ ফসলসহ গ্রীষ্মকালীন নানা জাতের শাক-সবজি ও ফলমূলের উৎপাদন বৃদ্ধির কর্মপরিকল্পনা। অন্যদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী ফসল উৎপাদনে প্রতিটি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে কৃষি বিভাগ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোহিত কুমার দে শেরপুর টাইমসকে জানান, চলতি মে মাসের মধ্যে বোরো ধান কৃষকরা ঘরে তুলে শেষ করতে পারবে। এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ ভাগ জমির ফসল কৃষক ঘরে তুলতে পেরেছে। এর পরপরই কৃষকরা আউশ ধান বপন শুরু করবেন। তুলনামূলক একটু উঁচু জমিতে ওই ধান রোপণ করতে হয়। এবার চার হাজার ৪৭ হেক্টর জমিতে ওই ধান রোপণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই আউশ উৎপাদনের জন্য সরকারের তরফ থেকে ইতোমধ্যে তিন হাজার কৃষককে প্রণোদনা বাবদ সার ও বীজ দিয়ে সহায়তা করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, জেলায় মোট আবাদি জমির পরিমাণ এক লাখ ছয় হাজার হেক্টর। জুন-জুলাই থেকে রোপা আমন বপন শুরু হবে। আগামী কিছু দিনের মধ্যে এর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হবে। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী প্রতিটি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। আর সে লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে কৃষি বিভাগ কাজ করছে। এ পর্যন্ত জেলার সদর উপজেলাসহ নকলা, নালিতাবাড়ি, ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নকলার কৃষক-কৃষাণীদের নিয়ে ৫টি উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য চলমান থাকবে। ওইসব উঠান বৈঠকের মাধ্যমে কৃষকদের বাড়ির উঠান, পুকুরপাড়, সড়কের পাশে, নদীর ধারে, বাঁধের ধারে এবং অনাবাদী পতিত জমি ফসল উৎপাদনের আওতায় আনতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
উপ-পরিচালক জানান, প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে ৫০০ মেট্রিকটন শাক-সবজি এবং ফলমূল পাওয়া যায়। বছর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় দুই হাজার মেট্রিকটন। তবে এবার সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ হাজার মেট্রিকটন ধরা হয়েছে। সে জন্য অনাবাদী ও পতিত পড়ে থাকা এক হাজার ৫৬০ হেক্টর জমি চাষাবাদের আওতায় আনা হয়েছে।
তিনি বলেন, কৃষকরা এখন গ্রীষ্মকালীন সবজি ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, শসা, কচু, চালকুমড়া, পুইশাক, পটল, ঢেঁড়স, করলা, মিষ্টিকুমড়া, কাঁকরোল, ডাটাসহ অন্য সকল কৃষি পণ্য উৎপাদনে মাঠে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া প্রান্তিক কৃষকদের প্রণোদনা হিসাবে এ পর্যন্ত ৮০০ জন কৃষককে সবজি বীজ দিয়ে সহায়তা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও এক হাজার ২০০ জন কৃষক এ সুবিধা পাবেন।
সদর উপজেলার বলাইয়ের চর গ্রামের কৃষক সোবহান মিয়া বলেন, কৃষি কর্মকর্তারা উঠান বৈঠকে আবাদি জমিতে ধান উৎপাদনের পাশাপাশি অনাবাদী পতিত পড়ে থাকা জমিতে আদা, হলুদ, লাল শাক, পুইশাক লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া বোরো ধান সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। কৃষি কর্মকর্তারা বলেছেন, করোনার কারণে ঘরে বসে থাকা যাবে না। সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে মাঠে কাজ করে জেলায় কৃষি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রাখতে হবে। তাই ঝুঁকি থাকা স্বত্বেও খাদ্য শস্য উৎপাদনের গতি ধরে রাখতে আমরা মাঠে নেমেছি।
সদর উপজেলার লছমনপুর এলাকার কৃষক আনোয়ার মিয়া ও সিরাজ বলেন, ক্ষেত্র বিশেষে কৃষি কর্মকর্তারা ৫/৭ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে আমাদের কৃষি বিষয়ক পরামর্শ ও সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। কৃষির জন্য তাদের পরিশ্রম দেখে আমরা উৎসাহিত হচ্ছি।
তারা জানান, এবার তাদের পুকুরপাড় ও বাড়ির সামনের সড়কের পাশে ঝিঙা, চিচিঙ্গা ও শসার আবাদ করেছেন। এছাড়া বাড়ির আঙ্গিনায় পতিত পড়ে থাকা ২১ শতাংশ জমিতে লালশাক ও উন্নত জাতের ডাটা বুনেছেন।
ঝিনাইগাতীর হলদি গ্রামের কৃষক দুলাল মিয়া বলেন, এবারের বোরো ধান ঘরে তোলার পরপরই আউশ জাতের ধান আবাদের জন্য জমি তৈরি শুরু করেছি। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার কৃষি উপ-সহকারী কর্মকর্তা তা পরিদর্শন করেছেন। এখন বীজ তলার কাজ চলমান আছে। আর কয়েকদিনের মধ্যেই আউশ ধান রোপণ শুরু হবে। মোট আট বিঘা জমিতে আউশ আবাদ করবো। কৃষি কর্মকর্তারা সার এবং বীজের জন্য তাদের সাথে যোগাযোগ করতে বলেছেন।
তিনি জানান, তার বাড়ির উঠানের ফাঁকা জায়গায় লাল শাক বপন করতে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বিনামূল্যে বীজ দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন করোনা কালে যেন খাদ্য ঘাটতি না হয় সে জন্য আমাদের সবাইকে এক সাথে কাজ করতে হবে।
নকলার বাউশা এলাকার কৃষাণী পারুল বেগম জানান, তার ৬০ শতাংশ জমিতে পেঁপের বাগান করেছেন। এর বাইরে আবাদযোগ্য তার অন্য কোন জমি নেই। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের দিক নির্দেশনায় এখন ওই ফল বাগানের ফাঁকে ফাঁকে ঢেঁড়স আর লালশাক রোপণ করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি আরও লাভবান হবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর উপ-পরিচালক মোহিত কুমার দে শেরপুর টাইমসকে বলেন, ফসল উৎপাদনে জেলার দুই লাখ ৮১ হাজার ৭৯০টি কৃষক পরিবার এখন মাঠে রয়েছেন। আর তাদের নানা পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন কৃষি বিভাগের ২১৯ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
তিনি জানান, এবার ৮৯ হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। চালের হিসাবে যা ৩ লাখ ৯৬ হাজার ৩৮৭ মেট্রিক টন।