শরীর যখন ভাইরাসের সাথে লড়াই করছে তখন যেসব উপসর্গ দেখা দেবে সেসব কমিয়ে আনতে চিকিৎসা নিতে হয়। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
পৃথিবী জুড়ে এখন এক নতুন আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। এ নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগবে এটাই স্বাভাবিক। নিজের মনে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর পেলে মনের অযথা ভয় অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যায়।
গত ৪ঠা মার্চ ব্র্যাকের অডিটরিয়ামে করোনাভাইরাস সচেতনতামূলক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ডাঃ সাইফ উল্লাহ মুনশি ব্র্যাককর্মীদের নানা জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়ার পাশাপাশি কথা বলেন করোনাভাইরাসের উৎপত্তি, এর প্রভাব এবং করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে আমাদের করণীয় সম্পর্কে। সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির সহযোগী পরিচালক ডঃ মোর্শেদা চৌধুরী। তাদের বর্ণনা ও প্রশ্নোত্তরের ভিত্তিতে নিচের বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
১. করোনাভাইরাস কী?
করোনাভাইরাস নোভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ হিসেবে পরিচিত। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। অনেক প্রজাতির করোনাভাইরাসের মধ্যে ৭টি প্রজাতি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। কোভিড-১৯ ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে। সার্স বা মার্স ভাইরাসের মতোই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের লক্ষণ দেখা দেয়।
২. করোনা ভাইরাসের লক্ষণগুলো কী?
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রাথমিক লক্ষণগুলো হচ্ছে, হাঁচি, কাশি, জ্বর, মাথাব্যথা। পরবর্তীতে নিউমোনিয়া এবং শ্বাসকষ্ট।
৩. করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন কি না তা জানতে কতদিন সময় লাগে?
আক্রান্ত ব্যক্তির স্পর্শ বা হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এই রোগ ছড়াতে পারে। রোগাক্রান্ত কেউ কোনো জায়গা স্পর্শ করার পর যেমন- পানির কল, দরজা, চেয়ার-টেবিল, বেসিন, দরজার হাতল, কমোডের সিট, সিট কভার, সুইচ ইত্যাদি সুস্থ কেউ স্পর্শ করলে তিনিও আক্রান্ত হতে পারেন। শরীরে রোগ লক্ষণ প্রকাশ পেতে ২-১৪ দিন সময় লাগতে পারে।
৪. কাদের জন্য এই রোগ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে?
যেকোনো বয়সি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে এবং কিছুদিনের মধ্যে সুস্থও হয়ে উঠতে পারে। আক্রান্তদের মৃত্যুহার কম। তবে বয়স্ক এবং অন্য কোনো রোগে আগে থেকেই (ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, অ্যাজমা ইত্যাদি) ভুগছিলেন এমন রোগী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
৫. করোনাভাইরাসের চিকিৎসা কী?
করোনাভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তবে শরীর যখন ভাইরাসের সাথে লড়াই করছে তখন যেসব উপসর্গ দেখা দেবে সেসব কমিয়ে আনতে চিকিৎসা নিতে হয়। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
৬. আক্রান্ত হলে কী করব?
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এমন মনে হলে আপনি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। এজন্য দেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর নির্দেশনা জেনে নিন এবং মেনে চলুন।
সন্দেহ হলে পরীক্ষার ফল না পাওয়া পর্যন্ত বাড়িতে থাকাই ভালো। এমনকি আক্রান্ত হলে চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়া বাকি সময় অবশ্যই বাসায় থাকতে হবে। পরিবারের অন্যদের সাথে মেলামেশা না করে আলাদা রুমে থাকতে হবে। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে তাকে ফোন করে জানিয়ে যাওয়া ভালো। তাতে হাসপাতালে অন্যদের ঝুঁকি কমে। অফিস, স্কুলÑযেখানে জনসমাগম ঘটে সেসব জায়গা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত অন্যদের থেকে আপনাকে আলাদা হয়ে থাকতে হবে।
বাড়ি থেকে বাইরে বের হলেও সঠিক নিয়মে মাস্ক পরে যাওয়া উচিত। আক্রান্ত ব্যক্তি এবং যিনি আক্রান্ত রোগীর সেবা করছেন উভয়েরই মাস্ক ব্যবহার করা জরুরি। অসুস্থতায় শুধুমাত্র মাস্ক ব্যবহার করা যথেষ্ট নয়। সুরক্ষার জন্য হাত সাবান- পানি দিয়ে ধোঁয়া বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করা এবং মাস্ক ব্যবহার করা উভয়ই দরকার।
আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে অন্তত ৩ ফুট দূরত্বে থাকতে হবে। এছাড়া হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় নাক-মুখে টিস্যু দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। হাতের কাছে টিস্যু না থাকলে কনুই দিয়ে নাক-মুখ ঢাকতে হবে। ব্যবহারের পর টিস্যু ঢাকনাযুক্ত বিনে ফেলতে হবে এবং সঠিক নিয়মে বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সাবান ছাড়াও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে। সাধারণ পরিচ্ছন্নতার অভ্যাসগুলো মেনে চলা জরুরি। সেইসাথে পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে।
৭. আমরা যেসব মাস্ক ব্যবহার করছি সেগুলো অধিকাংশই চীন থেকে আসছে। সেগুলো ব্যবহার কি ঝুঁকিপূর্ণ?
ভাইরাসের প্রাণ নেই। যতক্ষণ কোনো সেলের স্পর্শ না পায় ততক্ষণ এটি কোনো কাজ করতে পারে না। তাই চীন থেকে আমদানি করা মাস্কের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই।
৮. মৃত মানুষের দেহে ভাইরাস জীবিত থাকতে পারে কি না? অর্থাৎ, কেউ এই রোগে মারা যাওয়ার পরও কি ভাইরাস ছড়াতে পারে?
মৃত মানুষের দেহে ভাইরাস জীবিত থাকতে পারে না। তবে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের শ্লেষ্মা, প্রসাব এবং চোখের পানিতেও ভাইরাস পাওয়া গিয়েছে। সেক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা যেতে পারে।
৯. ইনফ্লুয়েঞ্জা হলে যেমন ভিটামিন সি খেতে বলা হয়, তেমনি করোনাভাইরাসের জন্য তেমন কিছু পরামর্শ আছে কি না?
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে ভিটামিন সি খেলে সুস্থ হওয়া যাবে এমন কোনো তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। তবে ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সুস্থ থাকতে সাহায্য করে।
১০. আমাদের আশেপাশে আক্রান্ত কেউ যদি হাঁচি-কাশি দেয় তাহলে খোলা জায়গায় ভাইরাস কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে?
জ্বর-কাশি হলে নিজে বা কারও হয়েছে দেখলে সুস্থতা রক্ষায় অন্তত ৩ ফুট দূরত্বে থাকুন। কোয়ারেন্টাইন থাকলেও একে অন্যের কাছ থেকে ৩ ফুট দূরে থাকার কথা বলা হয়েছে।
১১. করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য কী ধরনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়?
মানুষের শরীরের সকল ধরনের সিক্রেশন থেকেই যেমন-শ্লেষ্মা, প্রসাব-পায়খানা, রক্ত ইত্যাদিতে ভাইরাসের নমুনা পাওয়া যায়। সেগুলোই প্রাথমিক নমুনা হিসেবে ধরে পরীক্ষা করা হয়। চীন সিটি স্ক্যানের মাধ্যমেও করোনা ভাইরাস শনাক্ত করছে।
১২. সিটি স্ক্যানে করোনাভাইরাস শনাক্তের ফল ভুল হবার আশঙ্কা কতটুকু?
৯৬% সময়েই এটি সঠিক ফলাফল দেয়। তবে এর সাথে সময়, তারিখ, ডেলিভারি টাইম সব কিছুই খেয়াল রাখতে হবে।