কোরবানি শেষ! কিন্তু এখনও যেন রয়ে গেছে তার রেশ! এখনও যেন ঘুমের ঘোরে শুনতে পাই কোরবানি-পূর্ব আকাশ-বাতাস কাঁপানো সেই অমর কোরবানীয় বাক্য- ও ভাই, দাম কত?
হ্যাঁ, বলছিলাম কোরবানির আগে হাট থেকে গরু কিনে বাড়ি ফেরার কথা। হযরতপুর হাট থেকে ইটাভাড়া ব্রিজ পর্যন্ত কমচে কম ১০০ জন আবালবৃদ্ধবনিতা আমাদের জিজ্ঞেস করছিল… ও ভাই, গরুটির দাম কত?
সত্যি বলতে কি, আমি আগেই জানতাম গরু কেনার পর রাস্তাঘাটে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তাই বুদ্ধি করে আগেই আমি আমাদের পাড়াতো আফসু ভাইকে ৫০০ টাকা রোজে ভাড়া করে গরুর হাটে নিয়ে গিয়েছিলাম। গরুর রশি ধরা থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটে… ‘ও মিয়া ভাই গরুটির দাম কত’সহ নানান ধরনের প্রশ্নের উত্তরগুলো সেই-ই আনন্দচিত্তে দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ইটাভাড়া ব্রিজ সংলগ্ন বাজারে এসে তারও যেন মাথাটা বিগড়ে যায়! সে গরুর রশি ছেড়ে দিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগল, ভাইজান আমার আর ৫০০ টেকাও লাগত না, আর আমি এত কথার উত্তরও দিতে পারমু না! এ ধরেন রশি! আমি গেলাম!
সে সামনে পা বাড়াতেই আমি তার পথ আগলে ধরি। সে চলে যাওয়া মানে আমার মহাবিপদ! তবে আল্লাহ অশেষ মেহেরবানিতে চট করে যেন আমার মাথায়ও একটি লেটেস্ট বুদ্ধি চলে এলো। ইউরেকা ইউরেকা বলে চিৎকার করে আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলাম- ওহে প্রিয় আফসু ভাই! এইবার তুমি এই গরুটি ওই গাছের সঙ্গে বাঁধো! আর এই নাও ১০০ টাকা। এখন ওই যে ওই ‘জ্ঞানের আলো’ লাইব্রেরি দেখতেছ না! সেইখান থেকে চটজলদি কয়েক পিস কাগজ, একটি মার্কার কলম আর একটি সাদা স্কচটেপ নিয়ে আসো! দেখো আমার কারিশমা!
অতঃপর সুন্দর করে সেই কাগজে লিখলাম- এই গরুর দাম ৭০,০০০ টাকা। নির্বুদ্ধিতায় কেউ যদি আবারও সেটির দাম জিজ্ঞেস করে নিজেকে গরু বলে পরিচয় দেন; তবে কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়! পরে সেই লেখা কাগজটি আফসু ভাইকে দিয়ে গরুর পেট-পিঠ বরাবর দুই পাশে লাগিয়ে দিলাম! সেই সঙ্গে আফসু ভাইকেও সবিনয়ে নিবেদন করলাম, মিয়া ভাই! এমন দুটি লেখা কাগজ তোমারও পেট এবং পিঠ বরাবর লাগিয়ে দিলে কেমন হয়? আহা, সে কী আশ্চর্য! সে মহানন্দে রাজি হয়ে গেল!
চা-টা খেয়ে আমরা পুনরায় রওনা দিলাম। ব্রিজটি পার হতেই আবার শুরু হলো সেই জিজ্ঞেস পর্ব- ও ভাই, গরুটির দাম কত? এবার আফসু ভাই শুধু এদিক-ওদিক মাথা নাড়িয়ে গরুর পেট বরাবর ইশারা করতে লাগলেন। অন্যদিকে এমন অভিনব বুদ্ধির প্রশংসায় রাস্তাভরা লোকজন আমাদের দেখে মিটিমিটি আবার কেউ হিঃ হাঃ হুঃ হাঃ করে হাসতে লাগলেন।
এদিকে সন্ধ্যা হয়ে এলো। আফসু ভাইসহ গরুর গায়ে লেখা কাগজটিও তেমন দেখা যাচ্ছিল না। শুরু হলো আবার জিজ্ঞেস পর্ব। গ্রামীণ পথেও গরু-গাড়িসহ হাজার হাজার মানুষের ভিড় আর চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। হঠাৎ পেছন থেকে গরু ভর্তি একটি ট্রাকের বিকট হর্নের শব্দে আমাদের গরুটির মাথা যেন বিগড়ে যায়। সে বড় বড় চোখ করে মাথা মুচড়িয়ে আফসু ভাইকে টেনেহিঁচড়ে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। আমি অস্থির চিত্তে মোবাইলের লাইট অন করে তাদের পিছু পিছু দৌড়াতে লাগলাম আর… ও আফসু ভাই… ও আফসু ভাই গো বলে চিৎকার করে গ্রামের পুরো অন্ধকার রাস্তা কাঁপিয়ে তুলতে লাগলাম। তবে শেষ পর্যন্ত শেষ রক্ষা হয়। ঠিক ১০ মিনিট পর দেখি তুলাতুলি গ্রামের আমার নিকটতম বন্ধু মহসিনের বাড়ির পাশেই একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মনুষ্য জটলায় আফসু ভাই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন!
গরুটি গাছের সঙ্গে বাঁধা আর ওদিকে অজ্ঞান আফসু ভাইকে পানি ঢেলে মহসিন প্রাণপণে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টায় মত্ত!
হসাভার, ঢাকা