বঙ্গবন্ধু পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য শেখ রাসেল। বয়স তখন মাত্র ১০ বছর। জাগতিক ভালো-মন্দ কিছুই বুঝে আসেনি তখনো। ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুটি। অবাক করা বিষয় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কালো রাতে সেই নিষ্পাপ শিশুটিও রক্ষা পায়নি।
ঘাতকরা যখন ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায় তখন রাসেল নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য আশ্রয় নিয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে দীর্ঘদিন যাবত কর্মরত মোহিতুলের কাছে। ভেবেছিলো যেহেতু সে এখনো শিশু তখন নিশ্চয় ঘাতকরা তাকে হত্যা করবে না। যত নির্মমই হউক, তারা কি জানে না শিশু হত্যা মহাপাপ? এছাড়া সেতো রাজনীতি করে না। কিন্তু রাসেল ভুল ভেবেছিলো। সে বুঝতে পারেনি এরা সাধারণ ঘাতক নয়। এদের মিশন শুধু এ বাড়ির সদস্যদের হত্যা করা বা ক্ষমতার পালাবদলই নয়। এদের রয়েছে সুদূঢ় প্রসারী পরিকল্পনা। তারা ক্ষমতা বদলের পাশাপাশি গোটা রাষ্ট্রীয় কাঠামোটাই পাল্টে দিতে চায় চিরতরে।
কোনো কাকুতি-মিনতি কিংবা নিষ্পাপ মুখশ্রী নিষ্ঠুর দুর্বৃত্তদের মন টলাতে পারেনি। মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রাসেলের ছোট্ট বুক বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। শেখ রাসেল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা অঞ্চলের ধানমণ্ডিতে ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে ১৮ অক্টোবর, ১৯৬৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
সর্বকনিষ্ঠ ছেলে হওয়ায় পরিবারে আদর একটু বেশিই ছিল। বাসায় ফিরে ঘরে ঢুকে বাবা প্রথমেই খুঁজতেন রাসেলকে। রাসেল, ও আমার রাসেল বলে ভরাট কণ্ঠে ডাক দিতেন তার নাম ধরে। রাসেলও বঙ্গবন্ধুকে প্রচণ্ড ভালোবাসত। বাবাকে কাছে পাওয়ার জন্য, বাবার কোলে চড়ার জন্য অপেক্ষায় থাকত সব সময়। বাবার ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গেই এক দৌঁড়ে ছুটে আসত বাবার কাছে। অনেকক্ষণ পর বাবাকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরত, কিংবা উঠে পড়ত কোলে। বঙ্গবন্ধু তাকে কোলে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন পরম আদরে।
বাবার চশমাটাকে দারুণ লাগত তার, তাই সেটা বাবার চোখ থেকে খুলে নিজের চোখে লাগিয়ে নিতে বেশ মজা লাগত ওর। গল্প শুনতে খুবই ভালোবাসত ছোট্ট শেখ রাসেল। বাবা অবসরে থাকলেই গল্প শোনানোর জন্য আবদার জুড়ে দিত। বঙ্গবন্ধুও সময় পেলে বেশ আগ্রহ নিয়ে গল্প শোনাতেন। রূপকথার গল্প অবশ্য নয়, বাবা শুনাতেন একটি নিপীড়িত দেশ ও তার মানুষ এবং সংগ্রামের ইতিহাস, স্বাধীনতা অর্জনের গল্প। এসব গল্প শুনে হয়তো রাসেলেরও ইচ্ছা জাগত মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার, যুদ্ধ করে দেশটাকে স্বাধীন করার। এত ব্যস্ততার মাঝেও বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠতেন একজন প্রিয় পিতা। পিতা-পুত্রের আনন্দঘন আড্ডায় পুরো বাড়ি যেন স্বর্গ হয়ে উঠত।
কবি গোলাম হোসেন খান তার কবিতায় শেখ রাসেলের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-
দু’চোখ ভরা স্বপ্ন ছিলো তার
মুখে যেনো ফুটতো কথার খই-
ইচ্ছে হলেই যেতো লেকের পাড়
সারাটা দিন করতো যে চৈ চৈ,
পায়রাগুলোর যত্ন নিতো আর
সময়মতো পড়তো ঠিকই বই—
খুব আদরের ছিলো বাবা মা’র
রাসেল নামের সেই ছেলেটি কই?
শেখ রাসেল তখন ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনের আলো ফোটার মুহূর্তে একদল তরুণ বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা ট্যাংক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাসভবন ঘিরে ফেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাঁর পরিবার এবং তাঁর ব্যক্তিগত কর্মচারীদের হত্যা করে। এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য শিশু রাসেল মৃত্যুর আগে প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য হয়। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ও বিশ্বস্ত কর্মচারীরা রাসেলকে রক্ষা করার চেষ্টা করলেও অভ্যুত্থানকারীদের চোখে ধরা পড়ে যায়। আতঙ্কিত শিশু রাসেল ভয়ে কর্মচারী রমার পেছনে পালিয়ে নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। চারদিকের ভয়াবহ পরিবেশে ভীত রাসেল জানতে চেয়েছিল ওরা কি আমাকেও মেরে ফেলবে? রমা আশ্বস্ত করেছিলেন-না, ওরা তোমাকে কিছু করবে না। হয়তো রমা নিজেও বিশ্বাস করেছিলেন যে, এরকম একটি নিষ্পাপ শিশুর শরীরে কোনো জঘণ্যতম পাপীও আঘাত করতে পারে না। কিন্তু রমার সেই বিশ্বাস ভাঙতে সময় লাগেনি। রাসেল মায়ের কাছে যেতে চাইলে ঘাতকদেরই একজন তাকে সেখানে নিয়ে যায়। রাসেল সেখানে তার মায়ের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিল, আমি হাসু আপার (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) কাছে যাব। কিন্তু ইতিহাসের ঘৃণিত ঘাতকদের মন এতে গলেনি। ঘাতকদের একজন এই সময় শিশু রাসেলকে গুলি করে হত্যা করে।
কবি শারমিন সুলতানা রীনা তার কবিতায় শেখ রাসেলকে ফুটিয়েছেন এভাবে-
রাসেল হয়ে ফুটব
যারা গুলিতে ঝাঝরা করে
শেখ রাসেলের বুক
তারা মানুষরূপী জানোয়ার
রক্ত তাদের সুখ।যে শিশুটি হাসত খেলত
সারা বাড়ি ভরে
সবার সাথে সেও গেল
মায়ের আঁচল ধরে।
রাসেল মানে তাই তো বুঝি
মহাশোকের দিন
কেমন করে শুধবে জাতি
রক্তেরই এ ঋণ?রাসেল তোমায় কথা দিলাম
আমরা জেগে উঠব
তোমার হত্যার প্রতিশোধে
রাসেল হয়ে ফুটব।
মৃত্যু হলেও আজ শেখ রাসেল আছে এদেশের প্রতিটি মানুষের অন্তরে। অপার ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায়।
ওকে…