স্বাধীনতা যুদ্ধের পর উন্নয়নে গতি বেড়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। তবে সরকারের উন্নয়ন কাজ ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে মূল অবদান রাখছে খেটে খাওয়া মানুষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক দশক ঝুলে থাকা পদ্মা সেতু প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে দুই বছর আগে। স্বপ্নের এ অবকাঠামো এখন দৃশ্যমান। সেতুটি চালু হলে জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন আসবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের। মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হওয়ায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাতায়াতের সময়সীমা নেমে এসেছে চার ঘণ্টায়। গতি বেড়েছে বহির্বাণিজ্যে। নতুন চার লেন হওয়া ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দুই পাশে গড়ে উঠছে নতুন শিল্প কারখানা।
বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে শিল্প ও বাণিজ্য খাতে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে লক্ষণীয় হারে। বাড়ছে কর্মসংস্থান ও মজুরি। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান সচল রাখতে বিদ্যুৎ খাতে নেয়া হচ্ছে একের পর এক বড় বড় প্রকল্প। আলোর মুখ দেখছে স্বাধীনতার আগে থেকে ঝুলে থাকা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিদ্যুৎ, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে নেয়া প্রকল্পের সুবাদে বদলে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতির চালচিত্র।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালির অর্জন ছিল ভঙ্গুর অর্থনীতির স্বাধীন বাংলাদেশ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের তিন বেলা আহার জোটানো বড় দায় ছিল নতুন সরকারের। স্বাধীনতার পর দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল ৯২ শতাংশ মানুষ। আর মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় ছিল ১০০ ডলার। সময়ের ব্যবধানে দেশে দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশে।
অতিদারিদ্র্যের হার এখন ১২ দশমিক ৯০ শতাংশ। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বাধা অতিক্রম করে এখন ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬১০ মার্কিন ডলারে। বেসরকারি স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তকমা ঝেড়ে ফেলার যোগ্যতা অর্জনের অনেকটাই দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ।
অবকাঠামো খাতে ধারাবাহিক উন্নতির সুবাদে কৃষিনির্ভর দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে শিল্প খাত অর্থনীতির মূল ভিত্তিতে পরিণত হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে প্রথমবারের মতো জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান কৃষির দ্বিগুণে উন্নীত হয়েছে।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ৩২ দশমিক ৪২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কৃষি খাতের অবদান নেমে এসেছে ১৪ দশমিক ৭৪ শতাংশে। ২০১০-১১ অর্থবছরে জিডিপিতে শিল্পের অবদান ছিল ২৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো তা ৩০ শতাংশের ঘর অতিক্রম করে। ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির সুবাদে এবার তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ দশমিক ৪২ শতাংশে। এ হিসেবে সাত বছরে জিডিপিতে শিল্পের অবদান বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
অন্যদিকে ২০১০-১১ অর্থবছরের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল ১৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এরপর প্রতি বছর কৃষি খাতে প্রায় ২ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হলেও জিডিপিতে এর অংশ কমছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষির অবদান নেমে আসে ১৬ শতাংশে। পরের বছরের জিডিপিতে কৃষি খাত থেকে আসে ১৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। সর্বশেষ গত অর্থবছরে তা নেমে আসে ১৪ দশমিক ৭৪ শতাংশে। এ হিসেবে সাত বছরে কৃষির অবদান কমে ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
গত এক দশকে দেশের অর্থনীতির পরিধি প্রায় দ্বিগুণে উন্নীত হয়েছে বলে দাবি করছে বিবিএস। সংস্থার সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫। ২০০৩ সালে দেশে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৩৭ লাখ ৮ হাজার ১৪৪। ১৯৮৬ সালে স্থায়ী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৯২৬। বর্তমানে তা ৪৫ লাখ ১৪ হাজারে উন্নীত হয়েছে।
পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ব্যক্তি খাতে প্রবৃদ্ধির সুবাদে সরকারের রাজস্ব আয় প্রত্যাশিত হারেই বেড়েছে। অবকাঠামোসহ নানা খাতে সরকার প্রতি বছর ব্যয় করছে লাখ কোটি টাকার বেশি। পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্পও নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলেছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উড্ডয়নের অপেক্ষায় রয়েছে। অর্থায়নের অভাবে ১৯৬৪ সাল থেকে আটকে থাকা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৬ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। আর্থিক খাতে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেকটা সফলতা দেখাচ্ছে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনীতি অনেক এগিয়েছে। এর স্বীকৃতিও পাওয়া গেছে বিভিন্ন মহল থেকে। তবে এটাও ঠিক যে, আমাদের সক্ষমতার সবটুকু ব্যবহার করা যায়নি। অর্থনীতিতে আমাদের প্রায় সব অর্জন এসেছে খেটে খাওয়া মানুষের হাত ধরে।
তবে আয় বণ্টনে বৈষম্য নীতির কারণে দরিদ্র মানুষ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল খুব একটা পায়নি। আগামীতে সুষম উন্নয়নে জোর দিতে হবে। তাছাড়া শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা ছাড়া বিলাসী প্রকল্পে দাতাদের সহায়তা পাওয়া কঠিন। এসব প্রকল্প নিজেদের অর্থায়নেই বাস্তবায়ন করতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, প্রতি বছর শিল্প খাতে প্রায় ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আর কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ২ শতাংশের মতো। বেশি প্রবৃদ্ধির সুবাদে জিডিপিতে শিল্পের অবদান বাড়ছে, তবে কৃষির গুরুত্ব কমছে না। কৃষি খাতে এখনও প্রায় ৪২ শতাংশ শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। উন্নত প্রযুক্তির প্রচলন করে কৃষি খাতে শ্রমের ব্যবহার কমিয়ে তাদের শিল্প খাতে নিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, পৃথিবীর সব উন্নত দেশের মূল ভিত্তি শিল্প। বাংলাদেশেও সম্প্রতি শিল্পায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির রূপান্তরে অবকাঠামোগত উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলেও তিনি মনে করেন।