আমাকে নামাজ পড়তে দেখে মা ছুটে আসেন। হইচই শুরু করে দেন। কী করছো? কী করছো? তারপর সজোরে আমার গালে চড় বসিয়ে দেন। ধমক দিয়ে বলেন, কী হয়েছে তোমার? কে তোমাকে কী খাইয়েছে বলো। নিশ্চয় কেউ তোমাকে যাদু করেছে। মা এসব কথা বলতে থাকেন, কাঁদতে থাকেন। তারপর আমাকে ধরে বাইরে নিয়ে আসেন। ভাইয়াকে ডাকেন অনুক্ত জলদি আসো। একে কেউ যাদু করেছে। দেখো এ কী করছে এসব।
এ যা করছে আমাদের ভগবান যদি নারাজ হন তাহলে আর রক্ষে নেই। ও ছোট, নিষ্পাপ। কিছুই বুঝে না। ভগবান নারাজ হলে ওকে শাস্তি দেবেন। আমার মা বাবা ভাই তারা জানেন না আল্লাহ ছাড়া কারো কোনো শক্তি নেই। কেউ কারো কোনো উপকার কিংবা অপরকার করতে পারে না। তারপর তারা আমাকে বুঝাতে থাকেন। বাবা কোথাও গিয়েছিলেন। এরমধ্যে তিনিও এসে হাজির হন। বাবাকে সবকিছু খুলে বলা হয়। সঙ্গে মা এ কথাও বলেন, নিশ্চয় কোনো মোল্লা একে কিছু করেছে। কোনো কিছু খাইয়েছে। তারাতারি এর জন্যে কোনো তাবিজের ব্যবস্থা করুন। কোথাও নিয়ে যান।
তারপর আমার মা বাবা মন্দিরে মন্দিরে চক্কর দিতে থাকেন। কখনো বা চায়ের মধ্যে গুলিয়ে আমাকে কিছু পান করানো হচ্ছে। আবার কখনো পণ্ডিত থেকে ফুঁক দেয়া কোনো বস্তু এনে খেতে দেয়া হচ্ছে। ওসব বস্তু মুখে দিতেই আমার বমি হচ্ছে। এতে করে আমার মা বাবার বিশ্বাস দৃঢ়তম হচ্ছে এর বমি হচ্ছে কেন? সন্দেহ নেই এর ওপর কোনো জিন ছাড়া হয়েছে। ওই জিন একে আমাদের ভগবানের কোনো পবিত্র বস্তু খেতে দিচ্ছে না। বিভিন্ন জায়গা থেকে তাবিজ কবজ আনা হচ্ছে। আমার গলায় ঝুলানো হচ্ছে। আমি তাদেরকে নানাভাবে বুঝাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু তারা কোনো কিছুই কানে নিচ্ছে না।
অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো যত দ্রুত সম্ভব একে বিয়ে দাও। বিয়ে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আসলে সকলেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মা বাবা ভাবছিলেন যদি জানাজানি হয়ে যায় এ মুসলমানদের মতো কাজ কাম করছে তাহলে আমাদের জাত যাবে। আমরা সমাজ থেকে বহিস্কৃত হব। আমাদের দানাপানি উঠে যাবে। সমাজের কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলবে না। আমরা বয়কটে নিপতিত হব। মানুষ আমাদেরকে খোটা দেবে। তাছাড়া আমাদের অঞ্চলে কেউ কখনো স্বধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছেন এমন কথা কখনো শুনিনি। কিন্তু আমি কী করব, আমার আল্লাহ আমাকে হেদায়েত দান করেছেন। এখানে তো আমার কোনো হাত ছিল না। অবস্থা এ দাঁড়িয়েছে এখন কোনো ক্রমেই আমার পক্ষে ঘর থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন কী বলে বাইরে যাব? এখন সারাক্ষণ কেবল একই আলোচনা বিয়ে বিয়ে বিয়ে।
মা আমাকে বলছিলেন, আবার যদি তোমাকে নামাজ পড়তে দেখি তাহলে আমি মরে যাব। কূপে পড়ে জান দেব। বিষ খাব। আমি ভয় পেয়ে যাই। তাকে সান্তনা দিয়ে বলি, না আমি আর কখনো এমন করব না। তাকে সান্তনা দেয়ার জন্যে তার সামনে নামাজ পড়া ছেড়ে দিই। যখনই আবার লুকিয়ে নামাজ পড়তে শুরু করি তখন আমার মনের ভেতর শুরু হয় নতুন ঝড়। আমার ভেতর আমাকে জোর দিয়ে বলতে থাকে যদি আল্লাহর জন্যে নামাজই পড়তে না পারলে তাহলে বেঁচে থেকে কী লাভ? বিশ্বাস করুন, আমার মনের অবস্থা তখন এমনই ছিল। আমি তখন বারবার আল্লাহকে বলতাম হে আল্লাহ! তুমি কেন আমাকে তোমার দ্বীনের পরিচয় দিলে? আমি চারপাশে মেয়েদেরকে দেখতাম তাদের বিয়ে শাদি হচ্ছে। আমোদ ফূর্তি হচ্ছে। মা বাবা আপনজনদের সঙ্গে কী আনন্দে সময় কাটাচ্ছে। ভাবতাম হে আল্লাহ! তুমি আমাকে এদের মতোই থাকতে দিতে। তুমি কেন আমাকে তোমার পরিচয় দান করলে? এখন তো আমি আগুনের পথ চিনি। চিনি বেহেশতের পথ। যখন আমি সত্যের পরিচয় পেয়ে গিয়েছি তখন সে পথ আমি ছাড়ব কী করে।
এদিকে মা বাবাকে কাঁদতে দেখতাম। বাবার অবস্থা একেবারেই ভয়াবহ। বারবার স্টোক হতে থাকে। ভাবতাম বাবার কথা মেনে নিই। কখনো বা কাছে গিয়ে তাকে সান্তনা দিতাম। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন। আমার মনে হতো আমি যদি আল্লাহকে ছেড়ে দিই আর আল্লাহ তায়ালা যদি আমার বাবাকেও মেরে ফেলেন তাহলে আমার পরিণতি তো আরো ভয়াবহ হবে। ফিরে আসি আমি আমার আল্লাহর কাছে হে আল্লাহ! আমি এখন কী করব?
এভাবে ভয়ঙ্কর মানসিক যাতনা ও অস্থিরতার ভেতর দিয়ে ১৫-২০ দিন কেটে যায়। আমার চারপাশের সকল পথ বন্ধ। আমি ততদিনে জেনে গিয়েছিলাম ইসলামে আত্মহত্যা মহাপাপ। আত্মহত্যা করলে নরকে যেতে হবে। একদিনের ঘটনা। তখন সন্ধ্যা। আমাদের দ্বিতল বাড়ির ছাদে গিয়ে উঠি। তারপর সেখান থেকে লাফিয়ে পড়ি। মনে মনে ভেবেছিলাম আত্মহত্যার কারণে যদি আমাকে নরকে যেতে হয় তাহলে আল্লাহ তায়ালাকে বলব হে আল্লাহ! তুমি তো তোমার কাছে আসার আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো পথ আমার জন্যে খুলে রাখনি। আমি তো দ্বীনের পথে আসবার এবং তোমার দ্বীনকে শেখবার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমার কী করার ছিল?
আমার মা বা চাচ্ছেন হিন্দু ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে। আমি যদি তাতে রাজি হই তাহলে আমাকে শিরকে ডুব দিতে হবে।
ততদিনে আমি জেনে গিয়েলিাম শিরক সবচেয়ে বড় অপরাধ। আল্লাহ তায়ালার কাছে সর্বাধিক ঘৃণিত বস্তু শিরক। আমি বলব হে আল্লাহ! আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। এই ভেবে আমি তোমার কাছে আসার জন্যে ছাদের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়েছি। সুতরাং তুমি আমাকে আত্মহত্যার শাস্তি দিও না। এসব কথা ভেবে সত্যি সত্যি আমি ছাদের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ি। লাফিয়ে পড়ি মাথার নিচের দিকে দিয়ে। অথচ আল্লাহ তায়ালার মেহেরবাণী; দেখুন আমি যখন ছাদের ওপর থেকে পড়তে যাই তখন মনে হতে থাকে কে যেন ফিল্মের মতো আমার হাত ধরে ধীরে ধীরে আমাকে নামিয়ে দিচ্ছে। আমার পায়ে প্রচন্ড চোট লাগে। পা ফেটে যায়। বিষয়টা তখন খুবই বিস্ময়কর ছিল। আমি এতোটা উপর থেকে পড়েছি অথচ আমার পায়ে সামান্য চোট লেগেছে। পা ফেটে রক্ত বের হতে শুরু করেছে। এর বাইরে আর কোথাও আঘাত লাগেনি।
আল্লাহ না করুন যদি আমার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙ্গে যেত তাহলে আমি জীবনের তরে বেকার হয়ে যেতাম। মা বাবা ছুটে আসেন। কান্নাকাটি শুরু করে দেন। আমাকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। তারা উভয়ই অসুস্থ। তখন মা খুবই অসুস্থ ছিলেন। আমি জানতাম আমার মায়ের ক্যান্সার হয়েছে। কিন্তু আমি কী করব। আমার তো ইসলাম ছাড়া আর কোনো আশ্রয় নেই। প্রতিবেশীরা বলাবলি শুরু করে দেয় এ কেমন মেয়ে? মা বাবার নাক কেটে দিয়েছে। ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছে। তারা আমার প্রতি নানা রকমের অপবাদ দিতে থাকে। আমার ভেতরে ভেতরে কান্না করা ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। বাবা আমার এই অবস্থা দেখে বিছানায় পড়েন। আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যান। ডাক্তার চিকিৎসা চালাতে থাকেন। খুব খারাপ রকমের সময় পার হতে থাকে।
আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না মা বাবার কাছে থাকব, তাদের কথাই মেনে নেব, কী করব আমি! কিন্তু ঘুরে ফিরে আমার বারবার মনে হতে থাকে আল্লাহ তায়ালা যখন আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তখন তিনি আমাকে সাহায্য করবেন। আমি নিজে উঠাবসা করতে পারছিলাম না। নামাজও পড়তে পারছিলাম না। মা আমাকে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে যেতেন। আমার মা আজীবন আমাকে যে যত্ন করেছেন তার কোনো হক আমি আদায় করতে পারিনি। আমার মাকে আল্লাহ জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করেন।
সানা হুজাইফা : মুসলমানদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
নার্গিস ফাতেমা : আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করব, আল্লাহ তায়ালা সকলকে দ্বীনের ওপর অবিচল রাখুন। আমাদের চারদিকে দ্বীনদারির পরিবেশ গড়ে উঠুক। আমরা যেন বুঝতে পারি আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁকে মানবার জন্যে, সবখানে তাঁর দ্বীন ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে। আমাদের কর্তব্য সকলকে আল্লাহর দ্বীনের ওপর চলতে সাহায্য করা। আমি আশা করব, আমরা সকলেই এ কথা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করব আল্লাহ তায়ালা আমাকে সৃষ্টি করেছেন তার দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে। আমার কাজ, সকলের কাছে আমার নবীর সুন্নতগুলো পৌঁছে দেব। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণের চেষ্টা করব। খানাপিনা, উঠাবসা, এবং জীবন যাপনের সকল ক্ষেত্রে একমাত্র হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-কেই নিজের আদর্শ মনে করব।
আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর সকল মানুষকে ঈমানের ধণে ধন্য করুন। পৃথিবীর একজন মানুষও যেন কালেমা বিরত হয়ে পরকালমুখী না হয়। আল্লাহ তায়ালা আমার খান্দানেরও সকলকে কালেমা নসিব করুন। হিন্দু সমাজে অনেক মানুষ আছে তারা স্বভাবগত ভাবেই নিষ্পাপ চরিত্রের। আমরা মুসলমানরা কখনো তাদেরকে কিছু বলিনি। ইসলামের শিক্ষা তাদের সামনে তুলে ধরি না। যদি তাদের সামনে পবিত্র ইসলামের বাণী যথাযথভাবে উপস্থাপিত হয় তাহলে তারা নিশ্চয় ইসলামের বাণী কবুল করে নেবেন। দেখুন, আমি রাজস্থানের মানুষ। আমি অত ভাল করে আপনাদের ভাষায় কথা বলতে পারি না। ভাঙা ভাঙা ভাষায় আমি আমার গল্প আপনাদেরকে শুনালাম। দোয়া চাই, মরণ পর্যন্ত যেন আল্লাহ তায়ালা আমাকে তাঁর দ্বীনের ওপর অবিচল রাখেন। আমাকে যেন তাঁর দ্বীনের সেবায় কবুল করেন।
সানা হুজাইফা : বোন নার্গিস আল্লাহ তায়ালা আপনাকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন। আপনার ঈমানকে কবুল করুন। আপনাকে দাওয়াতের কাজে অবিচল রাখুন। আমিন।
নার্গিস ফাতেমা : আপনাকেও অনেক শুকরিয়া। আল্লাহ তায়ালার কাছে একটাই প্রার্থনা তিনি যেন আমাদের প্রতি খুশি থাকেন। আমিন।
সূত্র: মাসিক আরমোগান উর্দু, সেপ্টেম্বর ২০১৯
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: সানা হুজাইফা
ভাষান্তর: মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন