দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর পর সম্প্রতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পদোন্নতি জট খুলেছে। গত ৩ আগস্ট লক্ষ্মীপুর জেলার ২০১ জন সহকারী শিক্ষককে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির মধ্যদিয়ে এ জট খোলে। এর দুইমাস পর এবার টাঙ্গাইল জেলায় প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি পেলেন ২০২ সহকারী শিক্ষক। ১৩তম গ্রেড পাওয়া এসব শিক্ষকরা পদোন্নতির ফলে ১১তম গ্রেড অনুযায়ী সব সুবিধা পাবেন। ধারাবাহিকভাবে এ পদোন্নতি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
দীর্ঘদিন পর পদোন্নতি পেলেও ‘বাড়তি চাপ’ রয়েছে নতুন প্রধান শিক্ষকদের ওপর। পদোন্নতির আদেশে যেসব শর্ত যুক্ত করা হচ্ছে, সেগুলোকে বাড়তি চাপ হিসেবে দেখছেন তারা। বিশেষ করে আগামী এক বছরের মধ্যে কাজে ‘দক্ষতা’ দেখাতে না পারলে এবং ‘আচরণগত সমস্যা’ দেখা গেলে পদ হারাতে হবে প্রধান শিক্ষকদের। আবারও তাদের যেতে হবে সহকারী শিক্ষক পদে। এটিকে চাপ হিসেবে দেখছেন পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষকরা।
জানা গেছে, টাঙ্গাইল জেলার চার উপজেলার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২০২ জন সহকারী শিক্ষককে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মির্জাপুরের সবচেয়ে বেশি, ৭৩ জন। এছাড়া সখীপুরের ৫৫ জন এবং ধনবাড়ী ও বাসাইলের ৩৭ জন করে শিক্ষক পদোন্নতি পেয়েছেন।
সোমবার (৯ অক্টোবর) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তাদের পদোন্নতি দিয়ে অফিস আদেশ জারি করা হয়। এতে সই করেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ কবির উদ্দীন। আদেশে বলা হয়, ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০১৯-এর বিধি ৫(১) অনুযায়ী- টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর, সখীপুর, ধনবাড়ী ও বাসাইল উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২০২ জন সহকারী শিক্ষককে পদোন্নতিযোগ্য প্রধান শিক্ষকের শূন্যপদে গ্রেড-১১-এ শর্তসাপেক্ষে পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হলো।’
অফিস আদেশে তিনটি শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো- প্রধান শিক্ষক পদে যোগদানের তারিখ হতে এক বছর শিক্ষানবিশকাল হিসেবে বিবেচিত হবে। শিক্ষানবিশকাল সন্তোষজনক হলে তাদের স্থায়ী করা হবে। এ সময়ে তাদের আচরণ ও কর্ম সন্তোষজনক না হলে অথবা কর্মদক্ষতা অর্জনের সম্ভাবনা না থাকলে কর্তৃপক্ষ পদোন্নতি পাওয়া প্রধান শিক্ষকদের আবার আগের পদে (সহকারী শিক্ষক) পদাবনতি করাতে পারবেন।
পদোন্নতি পাওয়া অন্তত পাঁচজন শিক্ষকের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা বিষয়টিকে ‘অবশ্যই বাড়তি চাপ’ বলে মনে করেন। শর্তটি আগের পদোন্নতিগুলোর সময়ও ছিল। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন মনে করছেন তারা।
বাসাইল উপজেলা থেকে পদোন্নতি পাওয়া একজন শিক্ষিকা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘পদোন্নতি পেলেও বেতন-ভাতা কিন্তু খুব বাড়ছে না। কিন্তু ঝামেলার শেষ নেই। প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষককে শিক্ষার কাজ ছাড়াও নানান কাজ দেওয়া হয়। ৩০-৩৫টা রেজিস্ট্রার খাতা নিয়মিত মেইনটেন করা লাগে। এগুলো তো আমরা দেখেছি।’
তিনি বলেন, ‘এখন ঝামেলাটা বেড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও সবকিছু ডিজিটাল হওয়ায় কাজও বেশি। যখন-তখন উপজেলা ও জেলা শিক্ষা অফিস থেকে তলব করা হয়। জবাবদিহির শেষ নেই। সবমিলিয়ে কাজ করাটা এখন চ্যালেঞ্জিং। তারপরও শিক্ষকতা যেহেতু করছি, সেজন্য চেয়েছি একদিনের জন্য হলেও প্রধান শিক্ষক পদে দায়িত্ব পালন করবো। এখন পদোন্নতি পেলাম, কাজ শুরু করি, দেখি কতদূর এগোতে পারি।’
পদোন্নতি পাওয়া মির্জাপুর উপজেলার আরেক প্রধান শিক্ষক জাগো নিউজকে বলেন, ‘চাপ যে হবে, এটা সত্য। সামনে নির্বাচন, দায়িত্ব বাড়বে। দীর্ঘদিন প্রধান শিক্ষক ছিলেন না। চলতি দায়িত্বে একজন কাজ করেছেন। তার ক্ষমতার একটা সীমা ছিল। ফলে প্রতিষ্ঠানের সংস্কার থেকে বহু কাজ আটকে রয়েছে। এগুলো সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে করাটা খুব কঠিন হবে। উনিশ-বিশ হলেই হয়তো অভিযোগ জমা পড়বে। এমন বাস্তবতা মেনে নিয়েই কাজ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিজের প্রতিষ্ঠানে রাত-দিন খাটতে হলেও সেটা হয়তো মেনে নেওয়ার মতো। কিন্তু উপজেলা-জেলায় হঠাৎ শিক্ষা, শিক্ষক, এমপি-মন্ত্রী, সচিবদের অনুষ্ঠান হলেই ডাক পড়ে। নিজেকে তো যেতেই হবে, সঙ্গে দু-তিনজন করে অংশগ্রহণকারী নিতে হবে। যাদের নিয়ে যাবো, তাদের যাতায়াত এবং নাস্তা-খাবারের টাকাও অনেক সময় প্রধান শিক্ষকের পকেট থেকে যায় শুনেছি। এগুলো করে সবার মন যুগিয়ে চলা তো বিরাট চাপেরই ব্যাপার।’
বিষয়টি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহম্মদের দৃষ্টিগোচর করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘চাপের কিছু নেই। আপনি দায়িত্ব নেবেন, কাজ তো বেশি করতেই হবে। যারা পদোন্নতি পাচ্ছেন, তাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি মনে করি- তারা সবাই যোগ্য, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই প্রাথমিক শিক্ষাকে এগিয়ে নেবেন তারা। তারপরও কেউ ফেইল করলে (ব্যর্থ হলে), তাকে তো রাখার মানে হয় না।’
এদিকে, পদোন্নতি পাওয়া প্রধান শিক্ষকদের আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে টাঙ্গাইল জেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে যোগদান করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেউ যোগাযোগে ব্যর্থ হলে তিনি পদোন্নতি যোগ্য নন বলে বিবেচিত হবেন। একই সঙ্গে তার পদোন্নতির আদেশ বাতিল হবে।
যোগদানের দুই কার্যদিবসের মধ্যে নতুন প্রধান শিক্ষকদের পদায়ন করা হবে। এক্ষেত্রে চলতি দায়িত্ব বা ভারপ্রাপ্ত হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষকদের কর্মরত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদেই পদায়ন করার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
২০১৪ সালের ৯ মার্চ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদটি তৃতীয় শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়। ফলে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি চলে যায় পিএসসির অধীনে। নিয়োগ বিধিমালা, সহকারী শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতাসহ নানা কারণে পদোন্নতি বন্ধ হয়ে যায়।
অন্যদিকে বর্তমানে ১৮ হাজারের বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদ শূন্য। সেখানে সহকারী শিক্ষককে চলতি দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে। আর কয়েক বছরে তিন ধাপে ২৬ হাজারের বেশি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছে সরকার। সেগুলোতেও প্রধান শিক্ষক নেই। সব মিলিয়ে প্রায় ৪৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদ এখন শূন্য। নির্বাচনের আগেই পদোন্নতি দিয়ে শূন্য এসব পদ পূরণ করতে চায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
#জাগোনিউজ২৪.কম