যশোরের বেনাপোলের ধান্যখোলা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী-বিএসএফের গুলিতে নিহত বিজিবি সদস্য মোহাম্মদ রইস উদ্দীনের (২৫) দাফন সম্পন্ন হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে।
বুধবার (২৪ জানুয়ারি) সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টার দিকে নিজ গ্রাম শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের শ্যামপুর নুরেস মোড় এলাকায় আল মাদরাসাহ আল আরাবিয়্যায় জানাযার নামাজ শেষে সাহাপাড়া শ্যামপুর ভবানিপুর কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন করা হয়। এর আগে বিকাল সাড়ে ৪ টায় আকাশ পথে হেলিকপ্টার যোগে রইস উদ্দিনের মরদেহ শিবগঞ্জ উপজেলা স্টেডিয়ামে এসে পৌঁছায়। এ সময় নিহতের পরিবার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ব্যাটালিয়ন ৫৩ বিজিবি, রহনপুর ব্যাটালিয়ন ৫৯ বিজিবি ও যশোর ৪৯ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
পরে এ্যাম্বুলেন্স যোগে রইস উদ্দীনের মরদেহের কফিন পুলিশি নিরাপত্তায় তার বাড়ির আঙ্গিনায় পৌঁছিলে পরিবারের সদস্যদের আহাজারীতে এলাকার বাতাস ভারী হয়ে আসে। শোকে স্তব্ধ হয়ে যান এলাকাবাসী। রইস উদ্দীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের সাহাপাড়া গ্রামের কামরুজ্জামানের ছেলে।
বিএসএফের গুলিতে নিহতের দুই দিন পর বুধবার বিজিবি সদস্য রইস উদ্দিনের মরদেহ ভারতের গাঙ্গুলিয়া পাড়া সীমান্ত এবং বাংলাদেশের যশোর জেলার শার্শা উপজেলার শিকারপুর সীমান্ত দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সকাল সোয়া ১০টায় যশোর ব্যাটালিয়নের ৪৯ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসান আহমেদ জামিল ও সহকারী পরিচালক মাসুদ রানার কাছে হস্তান্তর করেন ভারতীয় বিএসএফের ১০৭ ব্যাটালিয়নের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা। পরে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তরে।
এদিকে মরদেহ বাড়িতে আসার খবর পেয়ে স্থানীয়রা মৃত রইস উদ্দীনকে এক নজর দেখতে ভীড় করেন তার বাড়িতে। এ সময় গ্রামবাসীর কান্না দেখে উপস্থিত বিজিবি কর্মকর্তা ও সিপাহীগণও তাদের কান্না চেপে রাখতে পারেননি। কয়েকজন সহকর্মীকেও এ সময় কাঁদতে দেখা যায়।
রইস উদ্দীনের বন্ধু আব্দুল মমিন বলেন, চাকুরির ৫ বছরের মাথায় মাত্র ৩ বছর আগে ধুমধাম করে বিয়ে হয় বন্ধু রইসের। বিয়ের মাত্র ৩ বছর পর ফুটফুটে ২টি সন্তান ও স্ত্রীকে একা ফেলে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল রইস। ছাত্র জীবন থেকেই সে বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ালেও নিজের নেই কোনো সঞ্চয় বা একটি আশ্রয়স্থল। গ্রামবাসীর আস্থার প্রতীক সে থাকলেও আজ তার পরিবারটিই আস্থার স্থল খুঁজছে। অসহায় ও এতিম হয়ে গেল পরিবারটি।
রইস উদ্দিনের মা রুমালি বেগম বিলাপ করতে করে বলেন, কেন তার ছোট সন্তানকে পাখির মত গুলি করা হলো ? সীমান্ত রক্ষা করতে গিয়েই কি অন্যায় করেছে তার সন্তান? এ সময় তিনি তার সন্তানের পরিবারের একটি আবাসস্থল এবং রেখে যাওয়া ২ সন্তানের দায়িত্ব নেয়ার দাবী করেন সরকারের প্রতি।
স্ত্রী নাসরিন বেগম স্বামীর পিতার পৈত্রিক ভিটায় স্বামীর মরদেহ পৌঁছার পর আহাজারী করে বলেন, তুমি রবিবার রাতে ফোন করে ছুটি পেয়ে বাড়ি ফিরতে চাইলে। আর ফিরলে লাশ হয়ে। এখন আমার রাফিয়া ও হাসানকে কে আদর করবে ? ওরা বড় হয়ে কাকে আব্বা বলে ডাকবে ? আমাদের তো আর কিছুই রইলো না।
মনাকষা ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত (৭, ৮, ৯ নং ওয়ার্ড) ইউপি মেম্বার শাহনাজ পারভীন লিলি বলেন, কৃষক কামরুজ্জামানের ৩ ছেলের মধ্যে রইস ছিল এলাকার প্রিয় মানুষ। গ্রামের সকলের বিপদে আপদে পাশে থাকায় স্বজনদের পাশাপাশি বন্ধু ও প্রতিবেশীদের মধ্যেও ছিল আর্তনাদ। অল্প বয়সে এমন মৃত্যু কেউই যেন মেনে নিতে পারছে না। ছোট দুইটি অবুঝ শিশু রেখে পরিবারের ছোট সন্তানটিকে মেরে ফেলা হলো। এতে তার পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে গেলো। দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে এলাকার একজন শহীদ হলো। আর তাই এমন হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠ বিচার চেয়ে শহীদ বিজিবি সদস্য রইস উদ্দিনের পরিবারের দায়িত্ব নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান এলাকাবাসী।
এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৫৯ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল গোলাম কিবরিয়া বলেন, সৈনিক রইস উদ্দীনের গ্রামের বাড়ি যেহেতু ৫৯ বিজিবির সীমান্ত এলাকায় সেহেতু আমরাই তার দাফন কাজের ব্যবস্থা করেছি। সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় তার দাফন সম্পন্ন করা হয়।
প্রসঙ্গত, ভারতের সুটিয়া ও বাংলাদেশের ধান্যখোলা সীমান্ত এলাকা দিয়ে সোমবার ভোরে চোরাকারবারিদের গরু আনার বিষয়টি টের পেয়ে বিএসএফ চোরকারবারিদের ধাওয়া করে। এ সময় বিষয়টি নজরদারী করতে বিজিবি সদস্যরা চোরাকারবারীদের ধরতে গেলে সিপাহী রইস উদ্দীন দলছুট হয়ে সীমান্তে এগিয়ে গেলে প্রথমে বিএসএফ সদস্যদের গুলিতে আহত হন। পরে বিএসএফ সদস্যরা ভারতের একটি হাসপাতালে ভর্তি করলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার দুপুর ২টার দিকে তিনি মারা যান। জানা যায়, রইস উদ্দীন ২০১৫ সালের জুন মাসে যোগ দেন বিজিবির সৈনিক পদে। এরপর থেকে বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের অধীনে সীমান্ত রক্ষায় দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে কর্মরত ছিলেন যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের ধান্যখোলা বিওপিতে।