অর্থনীতি শাস্ত্রের পন্ডিতরা বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক সংকট ও অত্যাসন্ন মন্দা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান করছেন। নিরবচ্ছিন্ন ভোগবাদী ধনী রাষ্ট্র বিচলিত হয়ে পড়েছে এই আশঙ্কা করে যে, তাদের আরাম-আয়াশের কী আবার ব্যাঘাত ঘটতে চলেছে! জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত প্রত্যক্ষ করছে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া। ভয়াবহ দাবানলের দাউ দাউ আগুন আধুনিক সভ্যতাকে তিরস্কার করে মাইলের পর মাইল গাছপালা ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ভস্ম করে দিচ্ছে। এতদিন দেখেছি, বন্যা হয় এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলোয়। এখন দেখছি, আটলান্টিক মহাসাগরপাড়ের উন্নত আধুনিক ধনী দেশেগুলো ও মধ্যপ্রাচ্যেও বন্যা হচ্ছে। তা হলে পৃথিবী কি বদলে যাচ্ছে? এর উত্তর এখনো সুনির্দিষ্ট হয়নি। হয়তো একদিন বদলে যাবে।
কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্বকে ধাক্কা দিয়েছিল। ওই ধাক্কা সামলে বিশ্ব আবার চলতে শুরু করেছিল, ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল বিশ্ব অর্থনীতি। ঠিক ওই সময় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুন করে সংকটের মুখে দাঁড় করিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে প্রায় ছয় মাস। এরই মধ্যে যুদ্ধ ও পশ্চিমা দেশগুলো প্রদত্ত রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার অভিঘাত পুরো বিশ্বে পড়েছে। বাংলাদেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এটি একটি দুর্বলতা। যুদ্ধ হয় রাজনৈতিক কারণে। কিন্তু এর অভিঘাত পড়ে জীবনের সর্বক্ষেত্রে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কবে থামবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। যে জাতিসংঘের দিকে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ চেয়ে থাকে, ওই সংস্থাও যুদ্ধ বন্ধের কোনো উপায় করতে পারছে না। জাতিসংঘের মহাশক্তিধর নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যের মধ্যে রাশিয়া ও চীন দুই সদস্য। রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য না থাকলে হয়তো যুদ্ধের গতিবিধি অন্যদিকে প্রবাহিত হতো, নিরাপত্তা পরিষদের ভূমিকা হতো ভিন্নরূপ।
বৈষম্যহীন ও শান্তিময় বিশ্বের জন্য জাতিসংঘের সামরিক শক্তিভিত্তিক পাঁচ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদের বিধি বিলুপ্ত করা প্রয়োজন। আকার, আয়তন আর বয়সে জাতিসংঘ বড় হলেও ন্যাটো {নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (এনএটিও)} নামক সামরিক জোটের শক্তিমত্তা ও কৌশলের কাছে বড় নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মূল কারণ ন্যাটো। আর ইতিহাস বলছে, ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল ন্যাটোর জন্ম হয়েছিল ভূতপূর্ব সোভিয়েত রাশিয়ার উত্থান রোধকল্পে। জাতিসংঘ যুদ্ধ করতে পারে না, ন্যাটো যুদ্ধ করতে পারে এবং জয়ী হয়। তাই এখন পুরো বিশ্ব যে সংকট, প্রকৃতিক বিপর্যয় ও যুদ্ধের মুখামুখি হয়েছে- এর মূল কারণ একক নয়, বহুবিদ। আর তা হলো সামরিক বাণিজ্য, পরিবেশ ও জলবায়ু দূষণ, রাজনীতির প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার গোপন কৌশল এবং সংযমহীন ভোগবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতি।
প্রবাদে আছে, নগরে আগুন লাগলে দেবালয় বাদ পড়ে না। এ কারণেই বৈশ্বিক এ সংকট বাংলাদেশকে ভাবিয়ে তুলেছে। দ্রারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়নের একটি ধাপ কেবল বাংলাদেশ সফলভাবে অতিক্রম করেছে। এই সময়ে যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত সংকট বাংলাদেশের চলমান উন্নয়নধারাকে ব্যাহত করতে পারে। এই মূহূর্তে বিশ্বের বাস্তবতা হলো- রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে, জ্বালানি ও খাদ্য সংকট এবং অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস দ-য়মান। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশকে তার নীতিকৌশল গ্রহণ করতে হবে। এ নিরিখেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন- এক. সব জমিতে চাষাবাদ ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দুই. রেমিট্যান্স নয়, রপ্তানি বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ (আমাদের সময়, ২৯ জুলাই ২০২২)। প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশনা পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে টেকসই উন্নয়নের পথে বাংলাদেশ আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে। কৃষি উৎপাদন ও রপ্তানির বৃদ্ধির জন্য এখন প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে অথচ খাদ্যশস্য নেই, তা হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মূল্য কোথায় থাকবে? কৃষি উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করতে পারলে বৈশ্বিক মন্দা খুব একটা ঘায়েল করতে পারবে না।
সংকট হতেই পারে। কিন্তু তা উত্তরণের জন্য দূরদর্শী ও সঠিক পরিকল্পনা এবং এর বাস্তবায়ন আবশ্যক। ১৯২৯ সালে সংঘটিত মহামন্দা থেকেও উত্তরণ পাওয়া গেছে। এর পরই যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতি হতে শুরু করে মহাকাশ গবেষণা- এসব কিছুতেই অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে। প্রশ্ন হলো, চলমান এই সময়ে বাংলাদেশের করণীয় কী? এক কথায় করণীয় নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। করণীয় বিবিধ এবং তা সল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। সংকট যাতে মহাসংকটে পারিণত না হয়, মন্দার অভিঘাত ন্যূনতম রাখা যায়- এ জন্যই বস্তুগত ও আচরণগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। বস্তুগত পদক্ষেপ কর্তৃপক্ষকেই গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আগাম কিছু পদক্ষেপ সরকার ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে। আচরণগত পদক্ষেপ রাষ্ট্রের সমাজ ও নাগরিকদের ওপর বর্তায়। অভ্যাসগত পদক্ষেপ নাগরিকদের গ্রহণ করতে হবে।
আমাদের অভ্যাস আছে- যখন কোনো কিছুর দাম বাড়ে, তখন এর প্রতি সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ি। পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি পেলে এর ভোগও বৃদ্ধি পাবে কেন? অভ্যাস পরিবর্তন সহজ বিষয় নয়। জাতীয় সংকটকালে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটা প্রয়োজন। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অনৈক্য হেতু সৃষ্ট সংকট। বৈশ্বিক এই সংকটকালে ‘আগুনে ঘি’ নিক্ষেপ সমকার্য যেন না ঘটে। এ সংকটকালে কয়েকটি বিষয় সদয় বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করা হলো। বিষয়গুলো হলো- এক. অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও অর্থপাচার এবং হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণ সম্পূর্ণভাবে বন্ধের ব্যবস্থা করা; দুই. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কেবল অপরিহার্য বিষয়ই অনুমোদন করা; তিন. বাজারে পেনিক ও গুজব রটা বন্ধ করা (অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বাজারে পেনিক ও গুজবকে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির একটি কারণ হিসেবে নির্ণয় করেছেন); চার. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কঠোরভাবে মনিটর করা, সম্ভব হলে সাময়িকভাবে বন্ধ করা; পাঁচ. গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা এবং ছয়. নাগরিক সমাজের দায়িত্বশীল আচরণ। এ সংকট চিরদিন থাকবে না। জাতীয় স্বার্থে আমাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
লেখক:-কল্যাণকর মিত্র : প্রাবন্ধিক ও পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।