অবশেষে মৃত্যু; ষোড়শ মৃত্যুর পরে
– ইয়াসমিন
মা অদ্ভূত রকমের ঘুম দিল, ওরা অনেকেই বলতে শুনছিলাম আমার মা নাকি আর কোনোদিন চোখ খুলে এমন বিস্বাদ পৃথিবীর মুখ দেখবে না।আর কোনোদিন জেগে উঠবে না।আমার ওতে কোনো মাথা ব্যথা নেই।আমি অগ্নিমূর্তি হয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে।সবার হাউ মাউ কান্না আর পাগলের মতো প্রলাপ মোটেই ভালো লাগছিল না।কোথায় কী এমন সমস্যা বুঝি না।ছোট খালা বলে উঠলেন, মেয়েটি একেবারে শোকে আহত।ইশারায় আমাকে দেখিয়ে দিল।
রাগটা মাথায় চড়ল, আচ্ছা ওরা কি চোখে দেখে না নাকি এতোটুকু বুঝজ্ঞান নেই যে একটা পাথরকে বার বার মেয়ে বলে পাগলের প্রলাপ বকছে!
বড়’পু, মেঝ’পু আর আর সবাই দেখি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সুর পেয়েছে- সবাই একই কাণ্ড ঘটালো।কাঁদছেই..আর আবোল-তাবোল পাগলের প্রলাপ!
আমি একদম ঠিক আছি।
ওদিকে বরই পাতা, শুকনো খড় আর বড় পাতিল ভর্তি জল এনে ছেঁড়া চাটাইয়ের আড়ালে রাখা হলো।বুঝতে বাকি নেই, মায়ের শেষ গোসল।পাড়ার অনেকে এল সবাই কাঁদছে, কেউ বলছে জেঠি খুব মহব্বতী মহিলা ছিল, অন্যজন বলছে নেক্কার বান্দা, কেউ কোনোদিন তার কপালটা পর্যন্ত দেখল না।সেকি পর্দায় থাকত চাচিটা।
লোকের সামনে কোনোদিন গেলো না গেলই না।জীবনটা পার করে ভালোই নেকি কামাই করল।
আমার মাথায় ঝিম ঝিম অবস্থা।কী অদ্ভূত সব মহিলা।
শুধু শুধু কাঁদছে।
গিন্নি চাচী এসেই আমাকে জোর করে জড়িয়ে ধরল, সেকি কান্না!মেয়েটা আর বাঁচবে না বলেই আমার মাথায় পিঠে হাত বুলালো।
মেয়েটা বড় অসহায় হয়ে গেলো! আবার চিৎকার, কান্না! এক ঝটকায় চাচীকে ছাড়িয়ে একপাশে গেলাম,
মূর্খ কানারা আমাকে কেবলই মেয়ে মেয়ে বলে সম্বোধন করছে।সব গর্ধভের দল, চোখে ছানি পরছে ওদের।
আচ্ছা পাথরের গঠন আর অনুভূতি কি মেয়েদের মতো হয় নাকি?
কেন আমাকে বার বার মেয়ে বলছে ওরা?গঠন আকৃতি মেয়েদের মতো তাই বলে কি আমাকে মেয়ে অর্থাৎ রক্ত মাংসের জলজ্যান্ত মানুষই ভাবতে হবে? আমার ভেতরে তো তাদের মতো অনুভূতির বালাই নেই, দয়া নেই, পরিবর্তন নেই, দুঃখ নেই।সবচে বড় কথা ওদের মতো দুনিয়ালোভ ও নেই।কোনো স্বার্থ নেই, নির্বাক নিথর এক মূর্তি, পাথরের মূর্তি।
মায়ের লাশটা যত্নে তুলে নিয়ে গেলো গোসলের নির্দিষ্ট জায়গাটায়।
আমার প্রচণ্ড বিরক্তির চোটে অনুভূতি জেগে উঠার উপক্রম।কেনই বা জাগবে না, এইসব কাণ্ড-কারখানা দেখে পাথরের মুখ ফোটে- সন্দেহ নেই।
অবশেষে গোসলের পালা শেষে কাফন পরানো হলো।আমার সামনেই ঘটছে, অথচ আমি তাদের মতো হৈ চৈ করছি না। কেন করব? এ দৃশ্য তো নতুন নয়।কতো শতবার এমন মৃত্যু নিয়ে খেলতে হলো।এটা এমন কী!এর আগেও পঞ্চদশ বার মায়ের দাফন হলো, ওদের মতো আমার কাঁন্না আসে না, পাথরের কান্না ঝর্ণা হয়ে যায় বলে।
অনেকগুলো কবর আমার ভেতর।
অবশেষে এই মৃত্যু ষোড়শ মৃত্যুর পরে!
কিছুক্ষণ পর পর মেঝ ভাই জ্ঞান হারাচ্ছেন, কে দেখে কাকে! প্রতিবেশীদের ভীড়, তারাই কেউ কেউ নিজেদের সামলিয়ে ভাইয়ের মাথায় পানি ঢালছে।
ভাবিরা নিষ্ঠুর হয় জানতাম, কিন্তু এ বাড়ির বউ -ঝি সমানই, কারো হুঁশ নাই, ঠাঁইহীন আর্তনাদ!
– ইয়াসমিন
সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম।
(শেরপুর টাইমস ডট কমের “সাহিত্য পাতা” সকলের জন্য উন্মুক্ত। আপনার স্বরচিত ছড়া- কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য ইমেল করুন sherpurtimesdesk@gmail.com এই ঠিকানায়।)