প্রত্যুষ ইসলাম :
মা ডাকছে রোহান পড়তে বসো। গেম খেলা অবস্থায় রোহান ক্ষ্রিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো একটু পরে পড়তে বসবো। একটু পর বলতে বলতে চলে গেল দুই ঘন্টা। রোহান তুমি এখনো পড়তে বসোনি কিন্তু, মোবাইল দাও অনেক হয়েছে অনলাইনে গেমে খেলা। এই বলে রোহানের মা মোবাইলটি নিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর রোহান ক্ষোভে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙতে শুরু করলো তার মা বাধা দেওয়ায় মায়ের উপরে আঘাত করতেও দ্বিধা বোধ করলো না রোহান। আমার বন্ধু রোহানের এমন কর্মকাণ্ডের কথা শুনে আমি খুবই লজ্জিত হলাম।
শুধু রোহান নয় রোহানের মতো লাখ লাখ শিশু কিশোর রয়েছে আমাদের এই বাংলাদেশে। যারা অনলাইন গেম এর জন্য প্রতিনিয়ত পিতা-মাতার অবাধ্য হচ্ছে। এই অনলাইন গেম গুলো যেন তাদের কাছে সবকিছু হয়ে উঠছে। অনলাইন গেম গুলোর প্রতি আসক্ত হওয়ার কারণে শিশুর আচরণে দেখা দিচ্ছে নেতিবাচক প্রভাব।
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যায়, সমগ্র বিশ্বের প্রায় ৩.২৪ বিলিয়ন মানুষ নিয়মিত অনলাইন গেম খেলে এবং তাদের অধিকাংশই হচ্ছে শিশু-কিশোর। বাংলাদেশ তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি মানুষ প্রতিদিন অনলাইন গেম খেলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণার পরে অনলাইন গেমের আসক্তিকে তারা মানসিক রোগ বলে অবহিত করেছে। আসক্তিকর অনলাইন গেম গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পাবজি ও ফ্রী ফায়ার। প্রতিদিন পাবজি গেমে যুক্ত হচ্ছে নতুন ৮০ হাজারের বেশি গেমার। এছাড়াও অন্যান্য গেমে যে প্রতিদিন নতুন করে কত গেমার যুক্ত হচ্ছে তার কোন নির্দিষ্ট হিসাব না থাকলেও সেটা কতটা ভয়াবহ হতে পারে পারে তা উপলব্ধি করা যায়।
এইসব অনলাইন গেমের বেশিরভাগ কনটেন্টগুলো প্রতিপক্ষকে আঘাত করা, গুলি করা ও রক্তপাত নিয়ে তৈরি হওয়ায় শিশুদের করে তুলছে হিংস্র খিটখিটে মেজাজের। এর প্রভাব শিশুদের আচার আচরণে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে বেড়ে যাচ্ছে অপরাধ করার প্রবণতা। অনলাইন গেমে শুধু শহরের শিশু-কিশোরেরা নয় আসক্ত হয়ে পড়ছে গ্রামের শিশু-কিশোররাও। আজকাল এসব শিশু কিশোরদের রাস্তায় রাস্তায় গেম খেলা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। এসব অনলাইন গেম শিশুদের-কিশোরদের সামাজিকীকরণকে বাধাগ্ৰস্থ করছে।
গেমের আসক্তি যেমন শিশুদের পড়াশোনার ক্ষতি করছে তেমনি শিশুদের ভবিষ্যতকে ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকারের দিকে। এছাড়াও এসব অনলাইন গেমের প্রভাবে শিশুদের ঘুমের সমস্যা হচ্ছে, শিশুরা শিকার হচ্ছে ডিপ্রেশনের এবং বিভিন্ন অনৈতিক কাজে লিপ্ত হচ্ছে।বর্তমানে দেখা যাচ্ছে গেম খেলার জন্য এমবি কেনার টাকা না থাকলে শিশুরা অন্যকে হত্যা এবং আত্মহত্যার মতো কঠিন পথ বেছে নিচ্ছে।আমরা নিশ্চয়ই চিনা দম্পতির কথা শুনেছি। যারা কম্পিউটারে গেম খেলার অর্থ জোগাড়ের জন্য নিজেদের সন্তানকে বিক্রি করেছে। আমরা আরো শুনেছি একজন কোরিয়ান নাগরিকের কথা। যিনি একটানা ৫০ মিনিট অনলাইন গেম খেলার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল।
এখানে বোঝাই যাচ্ছে অনলাইন গেম গুলো জীবন বিপন্ন করার পাশাপাশি আমাদের আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং এসব গেম ক্রমেই শিশুদের জন্য হয়ে উঠছে মারাত্মক ক্ষতির কারণ। আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, শিশুদের এসব গেম খেলার ডিভাইস কারা দিচ্ছে? শিশুরা কেন এসব অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে?বর্তমান পরিবারগুলো কতটুকু সচেতন? এসব প্রশ্নের উত্তরগুলো আন্দাজ করা যায় যে, পরিবারগুলো অনেক অসচেতন।
পরিবারগুলো শিশুদের এসব গেম খেলার ডিভাইস দেওয়ার ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা করছে না এবং শিশুকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে না। যার কারণে শিশুরা অনলাইন গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অনলাইন গেমগুলোর নানা ক্ষতিকর দিক ও নেতিবাচক প্রভাবের জন্য বিশ্বের অনেক দেশ এসব অনলাইন গেম গুলোর প্রতি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এবং বিভিন্ন ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও নেপালেও আসক্তিকর অনলাইন গেম গুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের আরেক পার্শ্ববর্তী দেশ চীন অনলাইন গেম খেলার ক্ষেত্রে তৈরি করেছে নীতিমালা। এই নীতিমালা অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সীরা সপ্তাহে ৩ ঘন্টার বেশি অনলাইন গেম খেলতে পারবে না। এখানে শিশুরা কোন সময় অনলাইন গেম খেলতে পারবে সে সম্পর্কে বলা হয়েছে এই নীতিমালায় বলা হয়েছে রাত ১০টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত শিশুরা কোন ধরনের অনলাইন গেম খেলতে পারবে না। এছাড়াও ওই নীতিমালায় বলা হয়েছে বয়সভেদে অর্থ জরিমানার কথা এবং সরকারি বন্ধের দিনগুলোতে শিশুরা অনলাইনে একঘন্টা গেম খেলতে পারবে। শিশুরা যেন পিতা-মাতার পরিচয়ে অনলাইন গেম খেলতে না পারে তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে দেশটি।
আমাদের দেশেও অনলাইন গেম পাবজি, ফ্রী- ফায়ার বন্ধের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি ছিল মাত্র ৩ মাসের জন্য ৩ মাস পর পুনরায় অনলাইন গেম গুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। আমাদের মনে কি কখনো প্রশ্ন জাগে না যে, আমাদের দেশের সরকার কেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিংবা চীনের মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলো না? এর উত্তর হয়তো কখনোই আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।
আমি এটা বলতে পারি যে যতদিন যাচ্ছে ততই এসব গেম শিশুদের জন্য ভয়াবহ হয়ে উঠছে। শিশুদের এসব গেমের আসক্তি থেকে মুক্ত করতে হলে সরকারের বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে সুশীল সমাজকে এবং সচেতন হতে হবে পরিবারকে ও অভিভাবককে। শিশুকে বোঝাতে হবে এসব গেমের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে এবং করতে হবে শিশুর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ। যতদিন না পর্যন্ত আমরা শিশুদের অনলাইন গেমের আসক্তি থেকে থেকে মুক্ত করতে না পারছি ততদিন পর্যন্ত আমরা শিশুদের ভবিষ্যতকে ঠেলে দিচ্ছি অন্ধকারের দিকে।
পরবর্তীতে দেশকে এর ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে। তাই এখন থেকেই শিশুদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমাদের সকলকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বর্তমান সময়ে শিশুদের অনলাইন গেমের আসক্তি থেকে মুক্ত করাই হোক আমাদের সকলের প্রতিজ্ঞা।
লেখক: প্রত্যুষ ইসলাম, শিক্ষার্থী ।
তথ্যসূত্র:
https://www.statista.com/statistics/293304/number-video-gamers/
https://tinyurl.com/ywmrnuzj
https://www.bbc.com/bengali/news-58329188.amp
https://www.reuters.com/world/china/china-rolls-out-new-rules-minors-online-gaming-xinhua-2021-08-30/
https://www.kalerkantho.com/print-edition/education/2019/11/21/841653
Number of gamers worldwide by region 2021 | Statista
নোট : পাঠকের কলামে লেখার দ্বায়ভার সবটুুকুই পাঠকের নিজস্ব, এখানে প্রকাশকের কোন দ্বায়ভার নেই।